ভুল করে দলে নেওয়া’ সেই ক্রিকেটারই বিধ্বংসী ইনিংস খেলে পাঞ্জাবের নায়ক

স্পোর্টস ডেস্ক: “তারা বিশ্ব ক্রিকেটের কিংবদন্তি, কিন্তু আমি যখন ব্যাট করতে যাই, নিজেকে মনে করি বিশ্বের সেরা। বোলারকে দেখি না, স্রেফ বল দেখি”- কী আত্মবিশ্বাসী ও প্রত্যয়ী উচ্চারণ! শুনলে মনে হতে পারে, বিশ্ব ক্রিকেটের বড় কেউ বলেছেন এমন কিছু। আদতে কথাটি বলেছেন শশাঙ্ক সিং। ভারতীয় ক্রিকেটেও খুব পরিচিত নাম তিনি নন। এবারের আইপিএলের নিলামে অবশ্য খবরের জন্ম হয়েছিল তাকে ঘিরে। তবে উচ্চ পারিশ্রমিকের কারণে নয়, নাম নিয়ে বিভ্রান্তির সূত্রে। নিলামে তাকে দলে নেওয়ার পর পাঞ্জাব কিংস দল থেকেই বলা হয়েছিল, এই ক্রিকেটারকে তারা চান না!
সেই শশাঙ্কই এখন পাঞ্জাবের স্মরণীয় এক জয়ের নায়ক। ২০০ রান তাড়ায় যেভাবে খেলেছেন তিনি, নিজেকে বিশ্ব সেরা বললেও যেন খুব বাড়াবাড়ি মনে হয় না ওই মুহূর্তটিতে।
আহমেদাবাদে গুজরাট টাইটান্সের বিপক্ষে বৃহস্পতিবার যখন ক্রিজে যান শশাঙ্ক, ২০০ রানের লক্ষ্যে ছুটে তখন নবম ওভারে ৭০ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলেছে পাঞ্জাব। শিখার ধাওয়ান, জনি বেয়ারস্টো, প্রাভসিমরান সিং ও স্যাম কারান- পাঞ্জাবের মূল ভরসারা সবাই তখন আউট। শশাঙ্ক ক্রিজে যাওয়ার একটু পর বিদায় নেন সিকান্দার রাজাও। কিন্তু বিরুদ্ধ স্রোতে সাঁতরে ঠিকই দলকে তীরে পৌঁছে দেন শশাঙ্ক।
উইকেটে যাওয়ার পরপরই এলবিডব্লিউর জোরাল এক আবেদন থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি। পরের বলেই ছক্কায় উড়িয়ে দেন আফগান বাঁহাতি রিস্ট স্পিনার নূর আহমাদকে। পরের ওভারে টানা দুই বলে চার ও ছক্কা মারেন অভিজ্ঞ উমেশ ইয়াদাভকে। ব্যস, আর থামাথামি নেই। রাশিদ খান, মোহিত শার্মা, আজমাতউল্লাহ ওমারজাইদের হতাশ করে ছুটতে থাকেন তিনি। শেষ ওভারের নাটকীয়তায় এক বল বাকি থাকতে দলকে জিতিয়ে মেতে ওঠেন বাঁধনহারা উল্লাসে। ৬ চার ও ৪ ছক্কায় অপরাজিত রয়ে যান ২৯ বলে ৬১ রান করে। শেষ দিকে ১৭ বলে ৩১ রানের মহামূল্য অবদান রাখেন আরেক আনকোরা নাম আশুতোষ শার্মা।
ম্যাচ শেষে স্বাভাবিকভাবেই পাঞ্জাবের উদযাপনের মধ্যমণি ছিলেন শশাঙ্ক। সেই ক্রিকেটার, নিলামে যাকে নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বিভ্রান্তি এবং তোলপাড়। গত ১৯ ডিসেম্বর আইপিএলের নিলামে ৭টা ৪৭ মিনিটে নাম ওঠে শশাঙ্ক সিংয়ের। বাংলার এই ক্রিকেটার অবিক্রিত রয়ে যান। মিনিট তিনেক পরই নাম ওঠে আরেক শশাঙ্ক সিংয়ের।
পাঞ্জাব তখন নিজেদের শূন্যতা পূরণে একের পর এক ক্রিকেটারকে দলে নিচ্ছে। মাত্রই আশুতোষ শার্মা ও বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংকে দলে নিয়েছে তারা। এরপর শশাঙ্ক সিংয়ের নাম উঠতেই তারা আগ্রহী হয় এবং ভিত্তিমূল্য ২০ লাখ রুপিতেই পেয়ে যায় দলে। পরের ক্রিকেটারের নাম যখন নিলামে ওঠে, তখন পাঞ্জাবের টেবিলে দেখা যায় মৃদু অস্থিরতা। পাঞ্জাবের সত্ত্বাধিকারীদের একজন প্রীতি জিনতা কিছু একটা ইশারা করেন নিলাম পরিচালনাকারীর দিকে। আরেক সত্ত্বাধিকারী নেস ওয়াদিয়া হাত নেড়ে বুঝিয়ে দেন যে, এই শশাঙ্ককে তারা দলে চান না।
আইপিএলের প্রথম নারী নিলাম পরিচালনাকারী মাল্লিকা সাগার তখন জানতে চান, ‘আপনারা এই ক্রিকেটারকে চান না?’ নেস ওয়াদিয়া আবার ইশারায় দেখান, ‘না।’ কিন্তু মাল্লিকা জানিয়ে দেন, এখন আর উপায় নেই, সময় শেষ হয়ে গেছে। না চাইলেও তাই ওই ক্রিকেটারকেই দলে রাখতে হয় তাদের। ভারতীয় সংবাধ্যমে ঝড় ওঠে, ভুল করে একজন ক্রিকেটারকে দলে নিয়ে ফেলেছে পাঞ্জাব। পরে পাঞ্জাব কিংসের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে ব্যাপারটির ব্যাখ্যা করে জানানো হয়, কাঙ্ক্ষিত শশাঙ্ক সিংকেই তারা পেয়েছে।
“পাঞ্জাব কিংস ব্যাপারটি পরিষ্কার করে দিতে চায় যে, শশাঙ্ক সিং সবসময়ই আমাদের আকাঙ্ক্ষার তালিকায় ছিল। কিন্তু একই নামের দুজন ক্রিকেটার তালিকায় থাকায় কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। আমরা তাকে দলে পেয়ে উচ্ছ্বসিত এবং আশা করি, আমাদের সাফল্যে সে ভূমিকা রাখবে।”
পরে শশাঙ্ক নিজেও সেই পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করে লিখেন, “সব ঠিক আছেৃআমার ওপর ভরসা রাখার জন্য ধন্যবাদ।” ভরসা ব্যাপারটি ক্রিকেট ক্যারিয়ারে খুব বেশি পাননি শশাঙ্ক। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আইপিএলে তিনি প্রথমবার দল পান সেই ২০১১ সালে। পুনে ওয়ারিয়র্সে থাকলেও সেবার ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। পরে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসে ছিলেন ২০১৭ আসরে, রাজস্থান রয়্যালসে ছিলেন ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত। ভাগ্য বদলায়নি। ম্যাচ তিনি পাননি একটিও।
অবশেষে ২০২২ আসরে সানরাইজার্স হায়দরাবাদে খেলার সুযোগ পান। ১০টি ম্যাচের একাদশে রাখা হয় তাকে। ব্যাটিংয়ে নামেন ৫ ইনিংসে। বেশি কিছু করতে পারেননি শেষ দিকে নেমে। সব মিলিয়ে করতে পারেন স্রেফ ৬৯ রান। এরপর গত আইপিএলে দলই পাননি। শুধু আইপিএলেই নয়, ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটেও দল থেকে দলে ঘুরেছেন তিনি ভাগ্য বদলের আশায়। মুম্বাইয়ের ক্রিকেটার উঠে আসার বিখ্যাত টুর্নামেন্ট কাঙ্গা লিগে খেলে অপ্রথাগত টেকনিক ও ছক্কার ঝড় তুলে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। কিন্তু মুম্বাই ক্রিকেটের মূল স্রোতে সেভাবে জায়গা করে নিতে পারছিলেন না। পরে পন্ডিচেরিতে পাড়ি জমান। ভাগ্য খোলেনি সেখানেও। অবশেষে ছাত্তিসগড়ে গিয়ে কিছুটা থিতু হতে পারেন।
এবার নিলামের আগে ভারতের একদিনের ম্যাচের টুর্নামেন্ট বিজায় হাজারে ট্রফিতে পরপর দুই ম্যাচে দেড়শ রানের ইনিংস খেলে নজর কাড়েন তিনি। এক ম্যাচে ১১ ছক্কায় ১১১ বলে করেন ১৫৪, পরেরটিতে ৭ ছক্কায় ১১৩ বলে ১৫২। নিলামের আগে সবশেষ ম্যাচে খেলেন ৫ ছক্কায় ৬২ বলে ৭৯ রানের ইনিংস। এরপর নিলামের ওই বিভ্রান্তি এবং তার দল পাওয়া।
পাঞ্জাবের অনুশীলনেও এবার ভালো করে প্রথম ম্যাচ থেকে একাদশে জায়গা করে নেন। শুরুর ম্যাচে যদিও আউট হয়ে যান প্রথম বলেই। তবে পরের ম্যাচে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে ৮ বলে অপরাজিত ২১ করে খানিকটা ঝলক দেখান সামর্থ্যের। তৃতীয় ম্যাচে অপরাজিত থাকেন ৭ বলে ৯ রান করে। এরপর বৃহস্পতিবারের ম্যাচ জেতানো ইনিংস। তার ৫৯ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস।
শুধু ব্যাটিং নয়, বোলিংও করেন তিনি। মিডিয়াম পেস, অফ স্পিন দুটোই করেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। আইপিএলে এবার যদিও বল হাতে পাননি এখনও। ম্যাচ জেতানো ইনিংসের পর শশাঙ্কের খ্যাপাটে উদযাপনই বলছিল, এই ইনিংস তার কাছে কতটা। ম্যাচ-সেরা হয়ে তার প্রতিক্রিয়াতেও তা ফুটে উঠল। “সত্যি বলতে, এখনও হজম করার চেষ্টা করছি। কারণৃ এই ব্যাপারগুলি সবাই কল্পনা করেৃ ম্যাচের আগে আমিও এমন কিছুর ছবি আঁকি কল্পনায়। কিন্তু সেটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সত্যিই খুব ভালো লাগছে। নিজেকে নিয়ে গর্বিত।”
পুরস্কার বিতরণীয় আয়োজনে সঞ্চালক সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার দিপ দাস গুপ্ত জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাশিদ, নূর, মোহিতের মতো বোলারদের খেলার সময় মাথার ভেতর কি চলছিল?” শশাঙ্কের উত্তরে মিশে থাকল তার প্রবল আত্মবিশ্বাসের ছাপ। “আমি সবসময়ই ক্রিকেটীয় শট বেশি খেলি। আমার কাছে ব্যাপারটি হলো, বল দেখা আর সেই অনুযায়ী খেলা। কোচও আমাকে এটিই বলেছেন। এমনিতে আমি সাত নম্বরে ব্যাট করি। আজকে পাঠানো হয়েছে পাঁচে (ছয়ে)। কোচ বলেছেন, স্রেফ বল বুঝে খেলতে।”
“তারা অবশ্যই বিশ্ব ক্রিকেটের কিংবদন্তি। কিন্তু আমি যখন ব্যাট করতে যাই, নিজেকে মনে করি বিশ্বের সেরা। বোলারকে দেখি না আমি, বল দেখি এবং সেই অনুযায়ী সাড়া দেই।” সেই সাড়া খুব ভালোভাবেই দিতে পেরেছেন তিনি এ দিন। এক যুগের বেশি সময় ভারতীয় ক্রিকেটে নীরব পদচারণার পর অবশেষে আড়াল ছেড়ে তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় এই ৩২ বছর বয়সে।


প্রকাশিত: এপ্রিল ৬, ২০২৪ | সময়: ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ