সর্বশেষ সংবাদ :

বেতশিল্প এখন আঁধার পথের পথিক

উপল আরাফাত: এক সময় ঘরের আসবাবপত্র বলতে প্রথমেই চোখে ভেসে আসতো বেতের কথা। বাড়িতে বইয়ের সেলফ, বসার মোড়া, সোফাসেট, খাট, অধিকাংশ আসবাবপত্রই ছিল বেতের। সাধারণ থেকে শুরু করে অভিজাত শ্রেণির মধ্যেও কদরও ছিল বেশ। তবে সেই সময় এখন অতিত। প্লাস্টিক শিল্পের বিল্পবসহ নানান ধরনের বোর্ডের জনপ্রিয়তার কাছে এক সময় আলোতে থাকা বেতশিল্প এখন আঁধার পথের পথিক। নিজের জৌলুস যেন হারাতে বসেছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী বেতশিল্প।
বেতশিল্পের সমৃদ্ধের কারণে রাজশাহী মহানগরীর একটি এলাকার নামই আছে বেতপট্টি। তবে আগের মতো সেই জৌলুস আর নেই সেখানে। বছর ১৫ আগে সেখানে ১৫টির বেশি দোকান থাকলেও এখন আছে মাত্র ২টি। অন্যদিকে নগরীর ঘোড়াচত্বর এলাকায় দেয়া যায় কয়েকটি দোকানের যেখানে বেতের তৈরি আসবাবপত্র বিক্রি হয়। বর্তমানে সেখানেই আছে কারখানাগুলো। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারেও এক সময় কয়েদীদের দিয়ে বেতশিল্পের কাজ করানো হতো। তবে কালক্রমে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। কারাসুত্র জানিয়েছে, বর্তমানে বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র নির্মাণ হচ্ছে। একসময় এ শিল্পের কাজ কারগারেও হতো। তবে খুব শিগগিরই বেতশিল্প নিয়ে কারাগারে কাজ করানো হবে বলে জানান কারা কর্তৃপক্ষ।
নগরীর হোসনীগঞ্জ বেতপট্টিতে এখনো বেতের আসবাবপত্রের দোকান আছে শফিকুল ইসলামের। দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ী তিনি। তিনি নিজেই কারিগর ও দোকানের মালিক।
শফিকুল ইসলাম জানান, তার দোকানে বেতের তৈরি মোড়া, বই রাখার তাক, চেয়ার, টি-টেবিল, ডাইনিং টেবিল, সোফা সেট, বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় দোলনা, ছোট-বড় রকিং চেয়ার।
বর্তমানে ধরন ভেদে চেয়ার বিক্রি হয় প্রতিটি দুই থেকে সাত হাজার টাকায়। সোফাসেট বিক্রি হয় ১৪ থেকে শুরু করে ৭০ হাজারে, মোড়া ৫০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা, ৬ সেটের ডাইনিং ১৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা। এছাড়া খাট ৫ থেকে ৭০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।
সবচেয়ে বেশি বেত উৎপন্ন হয় ইন্দোনেশিয়ায়। ইন্দোনেশিয়ায় উৎপন্ন বেতের গুণগতমানও সবচেয়ে উন্নত। এছাড়া ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডেও বেত জন্মায়। তবে রাজশাহীতে মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে বেত আসে সবচেয়ে বেশি।
সূত্র মতে, মিয়ানমার থেকে আসা প্রতিটি বেতের দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। যা ১০ থেকে ১২ ফুট লম্বা। এছাড়া দেশি বেত মোটাগুলোর মূল্য ১০০ টাকা ও ফালি বা পাতলা বেতের মূল্য ৩০ থেকে ৫০ টাকা। ভারত থেকে আসা বেতের মূল্য ১০০ থেকে ২০০ টাকা। ইন্দোনেশিয়ার বেতের মূল্য সবচেয়ে বেশি। ইন্দোনেশিয়ার একেকটি বেতের দাম পড়ে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। যা ১০ থেকে ১২ ফুট লম্বা হয়ে থাকে এবং ফালি বা পাতলা বেত ৭০০ টাকা করে কিনতে হয়।
তিনি জানান, বর্তমানে বেতের আসবাবপত্রের ব্যবহার অনেক কমে গেছে। আগের সময় বিয়ের অনেক উপহারের প্রধান আকর্ষণ ছিলো বেতের আসবাবপত্র। কিন্তু এখন এসব আর নেই। মানুষ খুব সহজেই অল্পদামে প্লাস্টিকের জিনিস পেয়ে যাচ্ছে। রাজশাহীর কয়েকটি রেস্টুরেন্ট, অফিসের শৌখিন পার্টিশন, সরকারি রেস্ট হাউজ ও সৌখিন ধনাঢ্য পরিবারগুলো স্বল্প পরিসরে বেতের আসবাব ব্যবহার করেন। বর্তমানে রকিং চেয়ার, দোলনা, সোফাসেট ও টি-টেবিলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
বেতপট্টি এলাকার হাসান ইমাম শাহিন জানান, এক সময় হোসনীগঞ্জের বেতপট্টির দু’পাশ জুড়ে ১৫টির বেশি দোকান ছিল। কিন্তু বেতের তৈরি জিনিসের চাহিদা কমতে থাকায় অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এখন মাত্র ২টি দোকান রয়েছে। চাহিদা না থাকায় বেতের পাশাপাশি বাঁশের তৈরি মালামাল বিক্রি করছেন তারা।
নগরীর ঘোড়াচত্বর থেকে বন্ধগেট এলাকায় কয়েকটি বেতের দোকান আছে। সেখানকার কারিগরদের মধ্যে কয়েকজন জানান, বাবার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই এই পেশায় কাজ করছেন তারা। অন্য কোন কাজ ভালোভাবে জানেন না। অনেকটা ভালোবাসা থেকেই বেতশিল্পের কারিগর হিসেবে কাজ করে।
বেতের দোকানের মালিক শফিকুল ইসলাম আরো জানান, চাহিদা কমে যাওয়ায় এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কারিগররাও। সবমিলে বেত সঙ্কট, শ্রমিক সঙ্কট, বাজারে পণ্যের চাহিদা কম থাকায় ধুকছে এই শিল্পটি। এই শিল্পকে বাঁচানো এখন চ্যালেঞ্জ ছাড়া আর কিছু না। কারণ আমাদের বয়স হয়েছে। বিকল্প পেশায় যাওয়া সম্ভব নয়। আর এই পেশায় নতুন করেও কেউ আসছেন না।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক জাফর বায়োজীদ বলেন, এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের কেউই যোগাযোগ করে না। ব্যবসায়ীরা তাদের সমস্যার কথাগুলো আমাদের জানালে আমরা সেইভাবে কাজ করবো। এছাড়া এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা মানুষগুলোকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করারও চেষ্টা করবো।


প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২২ | সময়: ৮:০২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ