সোমবার, ৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
নুরুজ্জামান, বাঘা:
জলবায়ু বলতে আমরা বুঝি কোন ভুখন্ড বা কোন দেশের ৪০ বছরের আবহাওয়ার গড় ফলাফল। মাটি, পানি, বাতাস ও বৃক্ষ এই চারটির সমন্বয়ে এর পরিবর্তন সাধিত হয়। জলবায়ুর সুষম অবস্থা কেবল জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য নয়, সুষম উন্নয়নের জন্যেও এর প্রয়োজন অপরিহার্য। এ জন্য আবহাওয়া অনুকুল রাখা প্রতিটা দেশের জন্য অনসিকার্য। আর এটি সম্ভব কেবল বৃক্ষ রোপন তথা সবুজ অর্থায়নে বিনিয়োগ বাড়ানো। বর্তমানে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন সরকার।
গত তিন বছর পূর্বে ১৭০ টি দেশের উপরে পরিচালিত এক সমিক্ষায় দেখা গেছে, জলবায়ুর পরিবর্তন হওয়াই সবচেয়ে ক্ষতির মুখে রয়েছে দক্ষিন এশিয়া। আর দেশের বিবেচনায় সবচেয়ে হুমকির মুখে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের ২-জুন বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জলবায়ু শীর্ষক ‘যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ গোলটেবিল আলোচনা সভায়’ এমনটি তথ্য উঠে এসছে। এ দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত, নেপাল চতুর্থ, আফগানিস্থান অষ্টম এবং পাকিস্থান রয়েছে ১৬ তম অবস্থানে। জলবায়ুর পরিবর্তনে সর্ব প্রথম দুর্ভোগের শিকার হন সমাজের দুর্বল শ্রেণীর মানুষ। এই দুর্বল শ্রেনী হলো নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা। জলবায়ুর পরিবর্তনে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছাস, খরা, সামুদ্রিক নিম্নচাপ জনিত প্রকৃতির রুঢ়তা শিল্প কলকারখানার বর্জ্য, গ্যাস, ধোয়ায় ব্যাপক ভাবে ক্ষতিকারক। আর এর জন্য দায়ী পশ্চিমা উন্নতদেশ সমূহ। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, পশ্চিমা উন্নত দেশ সমুহের কলকারখানার গ্যাস বর্জ ইত্যাদির প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবীর উত্তর অঞ্চল ও হিমালয়ে জমে থাকা লক্ষ বছরের বরফ গলে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্রে উষ্ণতা বাড়ছে। এর একমাত্র কারণ কার্বন গ্যাস।
লক্ষ করা গেছে, কার্বন জনিত কারণে প্রতি ৮০ বছরে পৃথিবীর তাপ মাত্রা বাড়তে থাকে দুই থেকে তিন ডিগ্রী সেলসিয়াস। দ্বিতীয়তঃ অনুন্নত ও মাঝারি শিল্প উন্নত দেশেও তৈরী হচ্ছে নানা ভাবে বায়ু দুষনের উপাদান। যেমন রেফ্রিজারেটর, ইয়ারকোলার, ইট ভাটার গ্যাস, সুর্য্যরে বেগুনি রশ্মি, শব্দ দুষন ইত্যাদিও বায়ু দুষনের অন্যতম কারণ। এ সবের ফলে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার বিষ্ফোরণ এবং তার মৌলিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে পৃথিবী দিন-দিন উপরোক্ত বিষয়ের কারণে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। এর জন্য প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে বায়ুস্তরে। যে কারণে সমাজের দুর্বল শ্রেণীর উপরে তার প্রতিক্রিয়া পড়ছে প্রতিনিয়ত। ডেঙ্গু থেকে শুরু করে নতুন নুতন মারাত্নক রোগ ব্যাধীর সৃষ্টি হচ্ছে। যার প্রথম ও প্রধান শিকার হচ্ছে সমাজের নারী ও শিশুরা। এ জন্য সরকার সবুজ বনায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন এবং এ খাতে ইতোমধ্যে বিনিয়োগ বাড়ানো হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম ইতোমধ্যে খবর প্রকাশ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালে উন্নত ও অনুন্নত দেশের সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক ভাবে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সরকার প্রধান বা রাষ্ট্র প্রধানগণ এক টেবিলে বসে দুষিত জলবায়ুর ফলে ক্ষুদ্র ও দুর্বল দেশগুলোর জন্য স্বাস্থ্য ধ্বংশ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে এর প্রতিকার করার চেষ্টা করেছেন। এ আলোচনায় বেশি-বেশি করে বৃক্ষ রোপনের পরামর্শ এসছে। সেখানে বলা হয়েছে, একমাত্র বৃক্ষয় প্রাকৃতিক ভারসম্মকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। এই বায়ু দুষনে গরীব দেশের নারী-শিশুরাই বেশী ঝুকির মধ্যে রয়েছে। সে দিক থেকে বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা সৃষ্টি করেছে জলবায়ু। আমাদের দেশের অভিঙ্গ মহলরা বলছেন, এমনিতেই বাংলাদেশের নারী-শিশুরা খুব দুর্বল অবস্থানে, তার উপরে জলবায়ুর ব্যাপক প্রভাব পড়ায় নারী-শিশু মৃত্যুর হার-সহ জটিল রোগের প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে।
এদিকে স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অ-সময়ে গর্ভপাতে জটিলতা ও খিচুনি জাতীয় রোগ প্রভাব বিস্তারর করছে নারীদের উপরে। এ ছাড়াও দেশের দক্ষিন অঞ্চলে সমুদ্র পৃষ্ঠ উষ্ণতার ফলে পানি স্তর ফুঁসে উঠেছে। অপর দিকে দেশের উত্তরাঞ্চলে পানিস্তর নেমে যাওয়ায় খাবার পানিতে অর্সেনিক-সহ কৃষিতে দেখা দিয়েছে চরম বিপর্যয়। এতে করে উত্তরাঞ্চলের জনসাধারণ নানা রকম বিপাকে পড়ছে। ফসল উৎপাদনের হার কোন-কোন বছর একেবারে কমে যাচ্ছে। যার বাস্তব চিত্র রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে গেলে লক্ষ্য করা যাবে। সেখানে কৃষকরা মারাত্নক ভাবে পানির সংকোট মোকাবেলা করছে কয়েক বছর ধরে। সেই সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে নানা রোগ বালাই। যা জনজীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে।
এ বিষয়ে আবহাওয়া ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্মকর্তাদের সাথে কথা বললে তারা বলেন, দুষিত জলবায়ু শিশু মৃত্যু, মাতৃ মৃত্যু ও অকাল গর্ভপাতে মারাত্নক হুমকি স্বরূপ এতে কোন সন্দেহ নাই। তাঁদের মতে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছে নান কল কারখানা। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে এর প্রবণতা পৃথিবীর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে সৃষ্টি হয়েছে বস্তি এলাকা। অপর দিকে নগর সভ্যতা মানুষকে করেছে আত্নকেন্দ্রিক। তাঁরা এটি প্রতিরোধের জন্য দেশের সর্বস্তরে বেশি-বেশি করে গাছ রোপনের পরামর্শ-সহ সরকারকে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন।
এদিকে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় সবুজ অর্থায়নে দেশে বৃক্ষ রোপন ও কৃষি খাতে উন্নয়নের প্রাণপন চেষ্টা চালাচ্ছেন সরকার। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি সব পরিকল্পনায় এখন সবুজ অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। সেই সাথে বাড়ানো হয়েছে বিনিয়োগ। ব্যবসা টেকসই করতেও উদ্যোক্তাদের সবুজ অর্থায়নে ঝণ দিচ্ছে বিভিন্ন ব্যাংক। এতে করে পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে দেশে সবুজে বিপ্লব ঘটতে চলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবুজ অর্থায়ন হলো পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ অর্জন করা। যেখানে গৃহীত শিল্প কিংবা কোনো অবকাঠামো নির্মাণ পরিকল্পনায় পরিবেশগত ঝুঁকি এবং পরিবেশগত ঘাটতি দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যা সরাসরি পরিবেশগত অর্থনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কিত।
এ প্রসঙ্গে সমাজের অভিঙ্গ মহল ও বিজ্ঞজনদের সাথে কথা বললে তারা বলেন, এই বিপর্যয় শুধু নারী, শিশু এবং বৃদ্ধদের জন্যই প্রজেয্য নয়, আমাদের দেশের জন্যও এটি চরম হুমকি স্বরুপ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমাজের সকল স্তরের মানুষ, গাছ পালা, কৃষি এবং অন্যান্য পশু পাখিও সমান ভাবে ক্ষতি গ্রস্থ হচ্ছে। তারা এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নত দেশ সমুহকে তাদের সকল প্রকার শিল্পের বর্জ্য এবং গ্যাস নিয়ন্ত্রন তথা অনুন্নত দেশের জন্য প্রয়োজনে ভূর্তুকী দ্বারা এ বৈষম্য সুসম ভাবে সমন্বয় সাধনের দাবী জানান।