আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে’ অর্থ পাচার দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক

সানশাইন ডেস্ক: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে পড়ায় গত বছরের জুলাই থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থপাচার হওয়ার বিষয়টি নিবিড় তত্বাবধান করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সেই উদ্যোগে ‘ওভার-ইনভয়েসিং’ বা পণ্যর অতিরিক্ত মূল্য দেখানোর প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে সফলতা এলেও ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ বা পণ্যের মূল্য কম দেখানোর মতো গুরুতর কয়েকটি ঘটনা উদঘাটন হয়েছে। বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়ে ত্রৈমাসিক ব্যাংকার্স সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় গত তিন-চার মাসের অর্থনীতি কেমন ছিল, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সামনে। সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, “অনেকদিন যাবৎ আমরা ট্রেডবেইজড মানি লন্ডারিং প্রতিহত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আমরা ইমপোর্ট ও এক্সপোর্ট মনিটরিং করি, ট্রেডবেউজড ট্রানজেকশনগুলো দেখি। ওভারইনভয়েসিং কঠোরভাবে দেখেছি। নিয়ন্ত্রণ করায় তা অনেক কমে গেছে। এখন আমরা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের তথ্য পাচ্ছি।
“আমরা কিছু কিছু আন্ডার ইনভয়েসিং তথ্য পাচ্ছি, যা গুরুতর। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে এটি হয়ত আমদানিকারকরা করছেন। পণ্যর কম দেখানো মূল্য পরবর্তীতে হুন্ডিতে পরিশোধ করছেন তারা। এ লেনদেনে হুন্ডি ব্যবহৃত হয়, হুন্ডির পরিসর বাড়ে, যা পুরো লেনদেন ব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট করে।” আন্ডার ইনভয়েসিং নিয়ন্ত্রণ করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আরও সচেতন হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিষয়টিতে গভর্নরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিাচালক সেলিম আরএফ হোসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “গভর্নর নির্দেশনা দিয়েছেন, আন্ডার ইনভয়েসিং যাতে না হয়, তা দেখা। ওভার ইনভয়েসিং অনেকটা কমে গেছে। এখন অগ্রাধিকার দিতে হবে আন্ডার ইনভয়েসিং কমানোয়। এখন ব্যাংকগুলো এদিকে নজর দেবে।”
গত মে মাসে ‘ব্যাংকিং সেক্টর আউটলুক-২০২৩’ সম্পর্কে ধারণা দিতে সংবাদ সম্মেলনে এসে সেলিম আর এফ হোসেন আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছিলেন। দেশ থেকে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার হওয়ার কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)ও। বৈদিশক বাণিজ্য ঘাটতি আগের চেয়ে কমে যাওয়া, ডলারের বিনিময় হারের চেয়ে কিছু ব্যাংকের দর বেশি নেয়া, খেলাপী ঋণ বৃদ্ধি উদ্বেগজনক হওয়া ও ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থাহীনতার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচিত হয় ব্যাংকার্স সভায়।
বাণিজ্য ঘাটতি কমে গেলেও আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল একাউন্ট) ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। সদ্য শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ হিসাবে ২ দশমিক ১৪ বিলিয়ন (২১৪ কোটি ২০ লাখ) ডলার ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। আগের অর্থবছ শেষে যেখানে উদ্বৃত্ত ছিল ১৫ দশমিক ৪৫ বিলয়ন (১ হাজার ৫৪৫ কোটি ৮০ লাখ) ডলার।
আর্থিক হিসাবের এ ঘাটতিকেই গভর্নর এখন বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলছেন বলে জানান সেলিম আরএফ হোসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করছে আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে কিভাবে তা সহনীয় পর্যায়ে আনা যায়। সভায় খেলাপি ঋণ (এনপিএল) বৃদ্ধি পাওয়াকেও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ খেলাপি। গত ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ নিয়ে এবিবি চেয়ারম্যান সেলিম হোসেন বলেন, “গত ২০-৩০ বছরের সমস্যা এক দুই বছরে মিটবে না। আমরা বলেছি, ধাপে ধাপে ব্যাংকগুলোতে কমিয়ে আনার কথা। এজন্য আইনি কাঠামোও প্রয়োজন।”
ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনা নিয়েও আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “নগদ টাকার প্রবাহ বেড়ে গেছে। তা এখন ব্যাংকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন অনলাইন লেনদেন বেড়েছে। ক্যাশলেস হচ্ছে- তখন কেন এত পরিমাণ নগদ টাকা ধরে রাখা হবে?” ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কিছু সমস্যা তো আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও সরকারের ঋণে ডিভল্ব কমিয়ে দিয়েছে। এখন তারল্য সরবরাহ বাড়বে।”
ব্যাংকগুলোতে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশিতে ডলার বিক্রি সেলিম বলেন, ব্যাংকগুলোর ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনাকেও বিষয়টি দেখতে হবে। কারিগরি সক্ষমতাও বাড়াতে হবে ব্যাংকারদের এ বিষয়ে, যাতে বেশি দরে ডলার বিক্রি না করে।” যে ব্যাংকগুলো বেশি দরে ডলার বিক্রি করছে, সেগুলো নজরদারিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র।


প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২৩ | সময়: ৫:১০ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ