শিশুদের দৃষ্টিশক্তি কমছে, বাড়ছে চশমার ব্যবহার

সানশাইন ডেস্ক: ৭ বছর বয়স থেকেই চশমা ব্যবহার শুরু করে রায়হান। আবার ১০ বছর বয়সী সাবিহারও দূরের কিছু দেখতে কষ্ট হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে সেও চশমা ব্যবহার শুরু করেছে। চিকিৎসক বলছেন, দীর্ঘসময় ধরে ডিজিটাল স্ক্রিনে চোখ থাকায় তার প্রভাব পড়েছে দৃষ্টিশক্তিতে। এর নাম মায়োপিয়া। তার বাবা মা’র ভাষ্য অনুযায়ী, বেশিরভাগ সময়ে সাবিহার সময় কেটেছে টিভি কিংবা মোবাইলে। করোনার মধ্যে বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না আর লেখাপড়াও ছিল অনলাইনভিত্তিক।
গত বছর ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের একদল গবেষক জানান, ঢাকার প্রতি একশ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৪০ শিক্ষার্থীর চোখে ত্রুটি আছে। হাসপাতালের শিশু চক্ষুরোগ ও স্কুইন্ট বিভাগের প্রধান মো. মোস্তফার নেতৃত্বে দলটি ঢাকার ১৯টি স্কুলের ৬ হাজার ৪০১ শিক্ষার্থীর চোখ পরীক্ষা করে। এরমধ্যে আড়াই হাজারের বেশি শিশুর চোখে ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন তারা। তাদের চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এসব শিশু নার্সারি থেকে দশম শ্রেণিতে পড়ে। তবে ঢাকার বাইরে এই হার কিছুটা কম।
চিকিৎসকদের মতে, মায়োপিয়া আক্রান্তরা দূরে থাকা বস্তু কিছুটা ঝাঁপসা দেখতে পায়। আক্রান্ত ব্যক্তিটি দূরে থাকা জিনিসটির যত কাছাকাছি যায় তত সেটি আরও স্পষ্ট দেখতে পায়। এর কারণ হলো, যখন আলো একটি মায়োপিক আক্রান্ত চোখে প্রবেশ করে, তখন এটি এমনভাবে বাঁকে যা দূরের বস্তুগুলোকে ঝাঁপসা করে দেয়।
একসময় মনে করা হতো জিনগত কারণে এশিয়ায় মায়োপিয়া আক্রান্তদের হার বেশি। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা মাত্র এক শতাব্দীর ব্যবধানে ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশে দাঁড়ায়। চীনে মায়োপিয়া এত প্রকট যে তা জাতীয় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন সামরিক সদস্য ও পাইলট খুঁজে পেতে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে দেশটিকে। এমনকি কোভিডের লকডাউনের পর শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়ার সমস্যা আরও বাড়তে দেখা গেছে।
২০ শতকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে ১২ থেকে ৫৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ৪২ শতাংশের মায়োপিয়া ধরা পড়ে, যা ৭০-এর দশকে ২৫ শতাংশের মতো ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে বড় কোনও জরিপ করা না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষু চিকিৎসকরা একমত যে মায়োপিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা অন্য যেকোনও সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
ঢাকার চক্ষু বিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, প্রতিদিন ৩ হাজার রোগী এখান থেকে চিকিৎসা নেন। এরমধ্যে গড়ে ৫০ শতাংশ রোগী শিশু যাদের দৃষ্টিশক্তি জনিত সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক কোটি ৪৩ লাখ লোক দৃষ্টি ত্রুটির সমস্যায় ভোগেন। দৃষ্টি ত্রুটি রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ছোটবেলা থেকে স্মার্টফোন, ট্যাবে ভিডিও গেমসের আসক্তি শিশুদের চোখের বিভিন্ন ধরনের সমস্যাসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এসবের জন্য খেলার মাঠ বন্ধ হয়ে যাওয়া, লেখাপড়ার বাড়তি চাপ, সূর্যের আলোয় শিশুর না আসা, দিগন্তে সবুজের দিকে তাকিয়ে না থাকাকেই দায়ী করা হচ্ছে।
তারা আরও বলছেন, শিশুদের যে সময় দূরের দৃষ্টি তৈরি হওয়ার কথা, সে সময়ই তারা মোবাইল ফোনের কিংবা ট্যাবের স্ক্রিনে দৃষ্টিকে আটকে রাখছে। যে কারণে দূরের দৃষ্টি প্রসারিত হতে পারছে না। বংশগত কারণেও এই ক্ষীণ দৃষ্টি হতে পারে, তবে স্ক্রিন অ্যাক্টিভিটি, রোদে খেলাধুলা না করা শিশুদের মায়োপিয়ার অন্যতম কারণ।
প্রতিষ্ঠানটির কনসালটেন্ট ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল আই কেয়ার কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শহিদুল ইসলাম বলেন, দেশে অন্ধত্বের হার কমেছে। ৩৫ শতাংশ কমেছে গত ২০ বছরে। কিন্তু চশমা ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় এমন দৃষ্টি ত্রুটি বাড়ছে। তার কারণ হচ্ছে, আমাদের ঘরোয়া কাজ বেশি হচ্ছে, বাইরে বের হওয়া কম হচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের বাড়ছে। কারণ, শিশুদের মধ্যে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের পরিমাণ বেশি। তাই চশমা ব্যবহারকারী রোগীর সংখ্যা শুধু বাংলাদেশেই না, সারা বিশ্বে বাড়ছে।
একই প্রতিষ্ঠানের শিশু চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আশিকুর রহমান আকন্দ বলেন, আমাদের এখানে প্রতিদিন তিন শতাধিক রোগী শিশু ইউনিটে আসে। সারা দেশ থেকেই সব ধরনের চোখের রোগ নিয়ে এখানে আসে। পাওয়ারের সমস্যা বড়দের যেমন হয়, শিশুদেরও হয়। দেখা যায় যে চারটি শিশুর স্ক্রিনিং করলে দুটি শিশুর পাওয়ারের সমস্যা। বাইরের দেশগুলোতে আরও বেশি। এখন দুটি কারণে বেশি রোগী আসছে। একটি হচ্ছে বেশি রোগী স্ক্রিনিং হচ্ছে। আরেকটি ইলেকট্রনিক গ্যাজেট বেশি ব্যবহারের ফলে। মোবাইলের আসক্তি একটি বড় ফ্যাক্টর, শহরের শিশুদের এই সমস্যা বেশি। সবাই ঘরের ভেতরে থাকায় যাদের সমস্যা নেই তাদেরও পাওয়ারের সমস্যা তৈরি হয়। এত বেশি মোবাইল ব্যবহারের ফলে চোখের সমস্যা এখন বেশি হচ্ছে। করোনায় অনলাইনে ক্লাস বেশি হওয়ার কারণে এই সমস্যা আমরা বেশি পাচ্ছি এখন।


প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২২ | সময়: ৫:২০ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ