সর্বশেষ সংবাদ :

জন্মনিয়ন্ত্রণের খরচও বাড়ল

সানশাইন ডেস্ক: নিত্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতির এ কঠিন সময়ে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে কনডম ও পিলের মত জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর মূল্য; কোনো কোনো পণ্যে বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতটা দাম বাড়ায় দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে প্রভাব পড়বে। আর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বলছে, সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে এসব উপকরণ বিনামূল্যে পাওয়া যায়। মানুষ চাইলে সেখান থেকে সংগ্রহ করতে পারে।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বিক্রি করেন সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি বা এসএমসি। সেসব সামগ্রীর দাম ও চাহিদা বেশি, সেগুলোরই দাম বেড়েছে বেশি। বৃহস্পতিবার রাজধানীর কয়েকটি ওষুধের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক প্যাকেট প্যানথার কনডমের দাম ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে। তাতে দাম বেড়েছে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
২৫ টাকার সেনসেশন কনডমের প্যাকেট ৪০ টাকা হয়েছে, দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ। ৪০ টাকার ইউঅ্যান্ডমি কনডমের প্যাকেটের দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। ৭০ টাকার এক্সট্রিম কনডমের প্যাকেটের দাম এখন ৯০ টাকা। এই পণ্যে দাম বেড়েছে ২৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
নারীদের জন্মবিরতিকরণ পিলের দামও বেড়েছে। আগে এক প্যাকেট ফেমিকনের দাম ছিল ৩৪ টাকা। সেটা এখন ৪০ টাকা হয়েছে। ফেমিকন সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির পণ্য। এই কোম্পানির আরেকটি পণ্য মিনিকনের দাম বাড়েনি। নোভিস্তার তৈরি ওভাস্টেট গোল্ডের দাম ৭ টাকা বেড়েছে। ৭০ টাকার প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৭৭ টাকায়। বিক্রেতারা বলছেন, এসব পণ্যই বাজারে বেশি চলে। অন্য যে পণ্যগুলো তেমন চলে না, সেগুলোর দামও তেমন বাড়েনি।
বনানী ২ নম্বর সড়কের এস রহমান ফার্মেসির ব্যবস্থাপক বিকাশ রায় বলেন, এসএমসি প্রতি সপ্তাহে তাদের পণ্য সরবরাহ করেন। তবে জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এসব পণ্যের সরবরাহ ছিল না। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে বর্ধিত দামে জন্ম নিয়ন্ত্রণের এসব পণ্য দিয়েছে। “এসএমসির কয়েকটি পণ্যে দাম বেশি পেয়েছি। কাস্টমাররা জানতে চায় দাম বাড়ল কেন। আমরা বলে দিই কোম্পানি বাড়িয়েছে। আমাদের তাতে কোনো হাত নেই।”
কুড়িল বিশ্বরোড এলাকার তাকওয়া ফার্মেসির মালিক আবুল হোসেন বলেন, বাজারে জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি। তাদের পণ্যের মধ্যে প্যানথার কনডম এবং ফেমিকন পিলের চাহিদা বেশি। দামও বেশি বেড়েছে এই দুটি পণ্যের। “যেগুলো রানিং পণ্য সেগুলোর দাম বাড়াইছে। যেগুলো চলে কম, সেগুলোর দাম বাড়ায় নাই। আমরা জানতে চাইলে কয় ডলারের দাম বাড়ছে এ কারণে মালের দামও বাড়ছে। কিন্তু ডলারের দাম এক টাকা বাড়লে তারা মালের দাম তিন টাকা বাড়িয়ে দেয়।”
লাকি ফার্মেসির বিক্রেতা বাদল হোসেন বলেন, “গত ১৫-২০ দিন এসএমসি কোনো মাল দেয় নাই। দাম বাড়াইয়া এই সপ্তাহে আবার মালি দিছে।” কুড়িল বিশ্বরোড এলাকার বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা এনাম আহমেদ বলেন, এভাবে হুট করে এতটা দাম বাড়ানো অযৌক্তিক। “শুধুমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব কোনো কারণ ছাড়া এবং সরকারের তোয়াক্কা না করে যে কোনোকিছুর দাম বাড়ানো। ৮০ টাকার টুথপেস্ট ১১০ টাকা, ২৫ টাকার টয়লেট টিস্যু ৩২ টাকা। জন্ম নিয়ন্ত্রণের এসব সামগ্রী কিনতে গিয়ে হয়ত কেউ দরদাম করে না, কিন্তু এটা ব্যয়ের বোঝা আরও বাড়াল।”
দাম এতটা বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে এসএমসি এন্টারপ্রাইজের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আপনি আমাদের জিএম মার্কেটিংয়ের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সবচেয়ে ভালো উত্তর দিতে পারবেন। তার আগে আমি উনার সঙ্গে কথা বলি।” তবে পরে এসএমসি থেকে আর কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে জন্মদানে সক্ষম দম্পতিদের মাত্র ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, ২০১৯ সালে তা বেড়ে ৬৩ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়।
দেশে এখন যেসব পদ্ধতি ব্যবহার হয়, তার মধ্যে খাবার বড়ির ব্যবহার সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ; ইনজেকশন ১১ শতাংশ। আর কনডমের ব্যবহার ৭ শতাংশ। জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা মেরিস্টোপস বাংলাদেশ-এর লিড অ্যাডভোকেসি মনজুন নাহার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জরুরি এসব পণ্যের দাম বাড়লে জন্ম নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে প্রভাব পড়বে।
“আমি হয়ত সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে বলতে পারব না, তবে এতে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে নারীরা তাদের পছন্দের পদ্ধতি নিতে পারে না। স্বামীর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে হয় তাকে। তার নিজের আয় না থাকায় পণ্যটি কিনতে পারবে না বা কেনার সংখ্যা কমে যাবে।” মনজুন নাহার বলেন, সরকার জন্ম নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত উপকরণ বিনামূল্যে দেয়, কিন্তু সরকারি কার্যক্রম সম্পর্কে মানুষ খুব একটা জানে না। আবার ঢাকায় তাদের কার্যক্রমও সীমিত। ফলে মানুষ সরকারি সেবাটা নিতে পারে না।
“সরকারি জন্ম নিয়ন্ত্রণ উপকরণগুলো কিন্তু ভালো। তবে ঢাকায় তিন বা চারটা জায়গা ছাড়া সরকারি এসব উপকরণ পাওয়া যায় না। ফলে বেশিরভাগ মানুষ ফার্মেসির ওপর নির্ভর করে। মানুষ যেন সরকারি সেবাটা পায় সেজন্য তাদের হাব বাড়াতে হবে অথবা বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের সঙ্গে যৌথভাবে এসব উপকরণ বিতরণ করতে হবে।”
সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর জন্ম নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সাত ধরনের উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করে। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছাড়াও পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ উপকরণ বিতরণ করেন। তবে ঢাকায় এই কার্যক্রম সীমিত।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপশন সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর ডা. নুরুন্নাহার বলেন, ঢাকার আজিমপুর মাতৃসদন হাসপাতাল, মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টার, মিরপুরের লালকুঠি মাতৃসদন, তেজগাঁও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং বাসাবো ক্লিনিক ছাড়াও মেরিস্টোপস, সূর্যের হাসি ক্লিনিক, এফপিএবি, বিএভিএস, পাথফাইন্ডার নামে প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকায় কাজ করছে।
“পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে সরকার সাতটি পদ্ধতি বিতরণ করে। বেসরকারি পর্যায়ে দাম বাড়লে কিছুটা সমস্যা মানুষের হতে পারে। সেক্ষেত্রে যারা টাকা দিয়ে কিনতে পারবেন না, তারা এসব হাসপাতাল বা ক্লিনিকে এলে বিনামূল্যেই পাবেন।”


প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৩ | সময়: ৭:০৭ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ