হঠাৎ নেয়া সিদ্ধান্তগুলোতে বাধাগ্রস্ত শিক্ষা প্রক্রিয়া

সরকার দুলাল মাহবুব: শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া। যে কোন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়ে তা ক্ষতির মুখে পড়ে। করোনাকালিন সময় থেকে দেখা গেছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নানান সিদ্ধান্তের কারণে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কখনো শীতে ছুটি, কখনো গরমে স্কুল বন্ধ। আবার কখনো আঞ্চল ভেদে রাখা হচ্ছে ক্লাস বন্ধ। শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি নিয়েও আছে বছর বছর নতুন সিদ্ধান্ত। কখনো বিকাশে তো আবার কখনো নগদে। এসব হঠাৎ নেয়া সিদ্ধান্তের কারণে শিক্ষা প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক গতিতে এসেছে মন্থরভাব। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক থেকে শুরু করে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা।
করোনার সময় থেকে শিক্ষায় দেখা দিয়েছে অশনি সংকেত। কারণে অকারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লাগাতার ছুটি থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এমনিতেই করোনাকালীন ও করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থী ঝরেছে আশংকাজনকভাবে। এরপর থেকে কোন প্রতিষ্ঠানই ঠিকভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেনি।
সরকারকে খুশি করতে এ কথা স্বীকার করবেন না যে, স্কুল ছুটি থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়াও নতুন ক্যারিকুলামে সেশন পরিচালনা করতে হলে ব্যাপক সময়ের প্রয়োজন। অবশ্যই যেসব শিক্ষক টিউশন বা কোচিংএর সাথে জড়িত তাদের পোয়াভারি। শহরের সচেতন অভিভাবক তাদের সন্তানদের টিউশন বা কোচিং করিয়ে কিছুটা হলেও ঘাটতি পূরণ করতে পারছেন। এতে করে টিউশন ও কোচিং বাণিজ্যের সাথে যারা আছেন তারা উৎসাহিত হচ্ছেন। এ অবস্থা থাকলে বিশেষ করে গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে এই নতুন ক্যারিকুলাম বাস্তবায়ন, কর্মমূখি ও সৃজনশীল শিক্ষা অর্জন মুখ থুবড়ে পড়বে বলে অনেকে আশংকা করেছেন।
এরপরেও বর্তমানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট থেকে নগদ মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। এরআগে বিকাশ, রকেট, ডাচ বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি আসতো। এখন থেকে সকল শিক্ষার্থীকে নগদ একাউন্টের মাধ্যমে উপবৃত্তি দেয়া হবে।
বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ থেকে নিদের্শ দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র নগদ মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টের মাধ্যমে উপবৃত্তি পাওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে সকল নগদ ছাড়া অন্য যে সকল একাউন্টে উপবৃত্তি পাওয়া যায়-এমন সকল একাউন্ট নগদ একাউন্টে রূপান্তর করতে হবে।
একটি সূত্র জানায়, পবিত্র রমজানের ছুটি শেষে চলছে তীব্র তাপদাহের অযাচিত ছুটি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ ধকলে শিক্ষার্থীদের ঝরে যাওয়া রোধ এবং উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানগুলো। কেহ স্বীকার করুন আর নাই করুন মূলতঃ করোনার সময় থেকে এ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম অনেকটাই এলোমেলোভাবে চলছে। করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইনে লেখা-পড়ার কথা বলা হয়েছিলো। সেই সুযোগে শিক্ষার্থীরা অভিভাবকদের কাছে থেকে স্মার্ট ফোন আদায় করেছিল। করোনাকালীন সময়ে অনেক ছাত্রী বিয়ে জনিত কারণে ঝরে যায়। সেই সাথে ছাত্ররা স্মার্ট ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে অনেকে শ্রেণিকক্ষে না এসে পাশের বাগানে রাস্তার ধারে মোবাইল ফোনে চ্যাটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এরপরেও প্রতিনিয়তই আসছে শিক্ষা বিষয়ক ফরমায়েস। একটি তথ্য দিতে দিতেই চলে আসছে আরো কিছু নির্দেশনা।
এমনিতেই নতুন ক্যারিকুলাম বিষয়ে ধারণা থাকা বা না থাকা নিয়ে নানা কথা, নানা মন্তব্য, নানা গুঞ্জন ও নানা গুজব অনেক পানি ঘোলা করেছে। তার রেশ কাটতে না কাটতে আবারো নগদ মোবাইল ব্যাংকিং -এ নির্দেশনা রূপান্তর এক ধরণের বাড়তি চাপ ভোগ করছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সর্বোপরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাও এসব নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে ছুটির মধ্যে। যেখানে শিক্ষার্থী নিয়েই কাজ-সেখানে ছুটি থাকায় বিড়ম্বনায় পড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এরপরেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে জানা গেছে। বাইরে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যতই চকচকে ঝকঝকে দেখা যাক না কেন-ভিতরে কাজ নিয়ে বেশ সদস্যায় পড়তে হচ্ছে শিক্ষকদের।
রাজশাহীর জেলার বেশ কিছু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে, বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট থেকে নগদ মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন। আপাত: সবঠিক থাকলেও সার্ভারে এন্টি করা যাচ্ছে না। যে কারণে তারা উপবৃত্তি না পাওয়ার হতাশায় ভূগছেন। পাশাপাশি বিষয়টি অভিভাবকদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে রোষানলে পড়ছেন। অনেকে বলছেন অমুকের মেয়ের হলে আমারটার হবে না কেন? তারা স্বজনপ্রীতির বা একাউন্ট পাইয়ে দেয়ারও অভিযোগ তুলছেন। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মাঝে এক অজানা আতংক বিরাজ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলার এক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, একবার ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা পাওয়া যায় নাই। উপজেলা মাধ্যমিক অফিসের কর্তাকে অনৈতিক সুবিধা না দেয়ায় ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়। এ নিয়ে ওই এলাকায় হৈচৈ পড়ে যায়। শিক্ষার্থীরা টাকা না পাওয়ায় শিক্ষকরাও নানা সমালোচনার সম্মুখীন হয়। অভিভাবকরা শিক্ষকদের সাথে মারমূখী আচরণ করেন। এমনকি শিক্ষার্থী অন্য বিদ্যালয়ে চলে যায়।
ওই বিদ্যালয়ে প্রায় পৌনে তিনশত শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পেয়ে থাকে। যারমধ্যে প্রায় একশো’ জন শিক্ষার্থীর নগদ একাউন্ট আছে। বাকি শিক্ষার্থীর অন্যান্য অপারেটরে একাউন্ট আছে। জানা গেছে, প্রায় এক সপ্তাহ চেষ্টা করে মাত্র ৫ জনের নগদ একাউন্টে আনতে পেরেছেন। একাউন্ট রূপান্তরের কারণে যদি উপবৃত্তি থেকে কোন শিক্ষার্থী বঞ্চিত হয়-তবে বিড়ম্বনার শেষ থাকবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, গরমসহ বিভিন্ন বাহানায় কিছু অভিভাবক, কিছু অভিজ্ঞজন বলে দাবি করেন এমন ব্যক্তি ও একটি রাজনৈতিক দলের কাজই হলো শিক্ষাকে কেমন করে আরো বেশী বেশী সার্জারি করা যায়। যা শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে অন্তরায়। আর এর ঘেরাটপে পা দিয়ে সরকারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কারণে অকারণে ছুটি ঘোষণা করছেন।
তিনি বলেন শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সাথে সাথে এই প্রক্রিয়া না চললে কখনোই শিক্ষার ঘাটতি পূরণ সম্ভব নয়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা ছোটকালে প্রাথমিকে ও মাধ্যমিকে দেখে এসেছি চৈত্র-বৈশাখ মাসে মর্নিং স্কুল বসতো। প্রচন্ড গরমে ২৪ কিলো.মি সাইকেল চালিয়ে কলেজে অধ্যয়ন করেছি। তাতেতো আমাদের অসুবিধা হয়নি।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কয়েকদিন আগেও করোনার মহামারি ছিল। তখন গরমে খেটে খাওয়া শ্রমিক, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনেকটাই সুরক্ষায় ছিল। যারা আরামে ছিল-তারাই বেশী মারা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু অভিভাবকের এনআইডি দিয়ে একাউন্ট খোলা থাকলেই হবে না- এমনকি নগদ একাউন্টের সীমও অবশ্যই একই এনআইডি দিয়ে রেজিস্টার করা থাকতে হবে। না হলে আপডেট হচ্ছে না। আবার বেশীরভাগ অভিভাবক বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের (বিকাশ, রকেট, উপায়…) মাধ্যমে একাউন্ট খুলেছেন। অনেক সময় ভুল তথ্যেও এজেন্ট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ একাউন্ট খুলে দিয়েছেন। এসব কারণে অনেক অভিভাবক সঠিকতথ্য উপস্থাপন করতে পারছেন না। তারা তাদের ছেলে-মেয়েদের উপবৃত্তি না পাওয়ার আশংকায় হতাশায় রয়েছেন। এরইমধ্যে শুরু হয়েছে গুঞ্জন ও গুজব। অনেকে আড়ালে বলছেন-সরকার উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমানোর জন্য-এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের কথা নগদ একাউন্টে উপবৃত্তির টাকা আসবে ভাল। কিন্তু প্রতিটি কাজের একটা ক্রমবিকাশ আছে। যদি ২০২৩ সালে ৬ষ্ঠ থেকে শুরু হতো তবে ২০২৮ সালে এমনি এমনি মাধ্যমিক স্তরে সকল শিক্ষার্থীর নগদ একাউন্ট হয়ে যেত। বেশীরভাগ সময়ে সার্ভার বন্ধ বা লোড নিতে পারছে না জেনে অনেকে এই নগদ-এ রূপান্তর জেলা বা বিভাগ ভিত্তিক করলে সুবিধার কথা বলেছেন।
জানা গেছে, গত কয়েক বছরে সরকারের ভাতা ও সহায়তা বিতরণ প্রক্রিয়া নগদ স্বচ্ছ ও আস্থার সাথে করে। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের সহায়তা বিতরণ একটি স্পর্শকাতর প্রকল্প। এর বিতরণের দায়িত্ব দিয়েছে নগদ মোবাইল ব্যাংকিংএর কাছে। আবার নগদের খরচও অনেক কম। এসবই নগদকে সব সময় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে। বর্তমানে দেশের অন্যতম সেরা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নগদ।
একটি সূত্র জানায়, এক সময় প্রাথমিক ভাবে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে প্রদান করা হলে টাকা বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে তা পরিবর্তন হয়ে ‘বিকাশ’ একাউন্টের মাধ্যমে প্রদান করা হতো। বিকাশের মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদানের সময় একটি ম্যাসেজের মাধ্যমে উপকারভোগীকে নিশ্চয়তা বার্তার মাধ্যমে তা জানানো হতো। পরে বিকাশ পরিবর্তন করে বর্তমানে ‘নগদ’ একাউন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মোবাইলে উপবৃত্তির টাকা প্রদান করা হয়ে থাকে। ‘নগদ’ একাউন্টের মাধ্যেমে টাকা প্রদানের পর উপকারভোগীদের মোবাইলে কোন নিশ্চয়তা বার্তা (ম্যাসেজ) না দেয়ায় অনেকেই ধুয়াশায় পড়ে থাকেন। টাকা না পাওয়া শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের কাছে জবাব দিহিতার মধ্যে পড়েন বিদ্যালয় শিক্ষকরা।
এ বিষয়ে পবা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে মোবাইলে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দিন বলেন, উপবৃত্তির টাকা না পাওয়ার কোন আশংকা নেই। অন্যান্য মোবাইন ব্যাংকিং একাউন্ট থেকে নগদ মোবাইল ব্যাংকিং এ রূপান্তর করতে হয়তো কিছু সময় লাগছে। তবে এ সমস্যাও দ্রুত কেটে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।


প্রকাশিত: মে ৫, ২০২৪ | সময়: ৫:০৯ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ