সেচ সংকটের আশঙ্কা : বোরো চাষ নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক

স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী ও রংপুরের ১৬ জেলায় বরেন্দ্র বহুমখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) সেচের আওতায় বোরো ধান চাষ করেন কৃষকরা। তবে বরেন্দ্র এলাকা হিসেবে পরিচিত রাজশাহী অঞ্চলে বিএমডিএর গভীর নলকূপগুলোতে ঠিকমতো পানি উঠছে না। প্রতিবছর শুস্ক মৌসুম শুরু হলেও পানির টান পড়ে। এবারো রাজশাহী জেলার পাশাপাশি সেচ সংকটের আশঙ্কা করছেন নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষকরা। এতে বাধ্য হয়ে ধানের বদলে অন্য ফসল চাষে ঝুঁকছেন তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজশাহী, চাপাই ও নওগাঁর ২১টি ইউনিয়নে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। যেখানে একসময় ১৬০ ফুট অ্যাকুইফার (পানির জলধারক স্তর) ছিল। এখন সেটা ৬ ফুটে নেমে এসেছে বলে পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার গবেষণায় বলা হয়েছে।
বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, তাদের তত্ত্বাবধানে ১৫ হাজার ৮২৩টি গভীর নলকূপ ও প্রায় ৮০০ লো-লিফট পাম্প রয়েছে। এর আওতায় রয়েছে ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমি। এর মধ্যে ৩ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হওয়ার কথা। এখনো ধান রোপণ শেষ হয়নি। সেচ সংকটসহ আরও কিছু কারণে ৩০০-এর কিছু বেশি গভীর নলকূপ এখন বন্ধ আছে। আর বিএমডিএর আওতাভুক্ত ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে এবার সেচসংকট রয়েছে।
বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুর রশীদ বলেন, গত বছরের চেয়ে বোরো চাষ এবার কম হচ্ছে। তবে এখনো রোপণ শেষ হয়নি। যে জমিগুলো বোরো চাষ থেকে বাদ পড়ছে, সেই জমিতে তাঁরা পানি সাশ্রয়ী অন্য ফসল করার জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছেন। যেসব গভীর নলকূপ থেকে আর পানি উঠছে না, সেগুলো সরিয়ে পাশে পুনরায় বসানোর চেষ্টা করছেন। নলকূপ সরিয়ে বসানোর এই ব্যবস্থাকে ‘পুনর্বাসন’ বলছে বিএমডিএ।
জানা গেছে, নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার কড়কড়িয়া গ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার কলেজপাড়া, রাজশাহীর তানোরের ঝিনারপাড়া, উচ্চাডাঙ্গা ও শিবপুর গ্রামে সাতটি নলকূপের সব কটিই প্রায় অচল হয়ে গেছে। সম্প্রতি রাজশাহীর তানোরের ঝিনারপাড়া, উচ্চাডাঙ্গা ও শিবপুর গ্রামে সাতটি নলকূপের সব কটিই প্রায় অচল অবস্থায় পাওয়া যায়। নলকূপগুলোতে এত কম পানি ওঠছে যে তা দিয়ে বোরোর আবাদ সম্ভব নয় বলে স্থানীয় কৃষকরা জানান।
বাধ্য হয়ে ওই গ্রামের বাসিন্দারা বোরো ধান চাষ বন্ধ করে দিয়েছেন। গভীর নলকূপের আওতাধীন জমিতে এখন কেউ আমবাগান করেছেন, কেউ অন্য ফসল চাষের চিন্তা করছেন। চাপাইনবাবগঞ্জের কলেজপাড়া গ্রামের গভীর নলকূপের অপারেটর শারমিন বেগম বলেন, এই গভীর নলকূপ থেকে এখন শুধু চৈতালিতে অল্প পরিমাণে সেচ দেওয়া হয়। আর ৮০টি পরিবারকে খাওয়ার পানি সরবরাহ করা হয়। খরার সময় খাওয়ার পানিও সরবরাহ করার সম্ভব হয় না। তখন যাঁর বাড়িতে সাবমারসিবল পাম্প আছে, লোকজন সেই বাড়ি থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন।
তানোরের ঝিনারপাড়া গ্রামের একটি গভীর নলকূপের অপারেটর হাসান আলী বলেন, এই গভীর নলকূপের আওতায় প্রায় আড়াইশ বিঘা জমিতে চাষাবাদ করা হতো। এখন কিছু জমিতে চৈতালি আবাদ করা হয়েছে, আর বাকি সব জমি পড়ে আছে।
নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার পাঁড়ইল ইউনিয়নের বনগাঁচান্দইল গ্রামের কৃষক দ্বিজেন চন্দ্র বর্মন বলেন, বনগাঁচান্দইল মৌজায় চারটি গভীর নলকূপ রয়েছে। আগের চেয়ে পানি কম উঠছে। এ জন্য উৎপাদন খরচ বাড়ছে।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) ২০২২ সালে জরিপ করে জানায়, গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে সেচকাজ চালানোর ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রতিবছর যে পরিমাণ নিচে নেমে যাচ্ছে, তা আর পুনর্ভরণ হচ্ছে না। ২০২২ সালে ‘সাসটেইনিং গ্রাউন্ড ওয়াটার ইরিগেশন ফর ফুড সিকিউরিটি ইন দ্য নর্থইস্ট রিজিয়ন অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়, বোরো চাষে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পানির স্তর নামছেই। বর্ষা মৌসুমেও এ স্তর স্বাভাবিক অবস্থায় আসছে না।
পানিসংকট মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো কৌশল বিভাগের অধ্যাপক নিয়ামুল বারী বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য বরেন্দ্র এলাকায় যেসব পুকুর, খাল ও খাঁড়ি রয়েছে, সেগুলো থেকে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। এ থেকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পানির চাপ কমবে।


প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৪ | সময়: ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ