সর্বশেষ সংবাদ :

মহান মে দিবস আজ : স্বর্গ সাজানো কারিগররা থাকে নরক পরিবেশে

স্টাফ রিপোর্টার: মাঠের পর মাঠ ভরা ফসল। তপ্ত রোদে অসংখ্য শ্রমিকরা ব্যস্ত জমি পরিচর্যায়। কেউ ব্যস্ত ফসল ঘরে তোলায়। আবার কেউ পণ্য উৎপাদনে শিল্প-কারখানায় ব্যস্ত। আগুনের পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে কেউ বা মনোযোগি মানুষের মুখে রসনার স্বাদ তুলে দিতে। ধুলি-বালি শরীরে মেখে কেউ বা অন্যের অট্টালিকা নির্মাণের কাজে। এই তপ্ত রোদে ইটভাটা থেকে গরম ইট মাথায় নিচ্ছেন নারী-পুরুষ। এমন অসংখ্য কাজে জড়িয়ে থেকে শ্রমিকরা ব্যস্ত থাকে দেশকে স্বর্গের মতো করে সাজাতে। কিন্তু তাদের অবস্থা কি? এমন কাজ তারা দিনের পর দিন করে যাচ্ছেন নরক পরিবেশে থেকে। তাদের কথা কেউ ভাবে না, ভাবতেও চায় না। মে দিবস আসে তাদের কথা উঠে আসে আলোচনায়। দিবস দিনের সূর্য ডুবতেই শেষ। আবার চিত্র আগের মতোই। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে থাকে না তাদের কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
অথচ দেশের অর্থনীতির চাকা স্বচল রেখেছে শ্রমিকরাই। প্রত্যক্ষভাবে শ্রমিকদের শরীরে ঝরা ঘাম থেকেই গড়ে উঠছে দেশ। তবে দেখা গেছে ওই শ্রমিকদেরকেই কাজ করতে হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। দীর্ঘদিন ধরে এমনটি চলে আসছে। যে শ্রমিক যে শিল্প-কারখানায় কাজ করবেন বা যে মালিকের অধিনে কাজ করবেন তাদেরই দায়িত্ব শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশের ব্যবস্থা করে দিতে। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই আলাদা।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ করেছিল। সেই জরিপের হিসেবে দেশে ৭ কোটি ১০ লাখ শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। তাদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ কৃষিতে, ৩৮ শতাংশ সেবায় ও ১৭ শতাংশ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় কাজ করেছেন। এসব শ্রমিকদের বেশিরভাগই কাজ করছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও জীবনের ঝুকি নিয়ে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর ২০২২ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ২০২২ সালে দেশে ৭ কোটি ৪ লাখ শ্রমিক কাজ করেছে। কর্মরতদের মধ্যে ৩২ শতাংশ শ্রমিক ধুলো, শব্দ ও কম্পনের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেছে। আর তীব্র ঠাণ্ডা ও গরমের মধ্যে কাজ করেছে ৩০ শতাংশ শ্রমিক। প্রতিকুল পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন প্রায় ২৪ লাখ ১০ হাজার শ্রমিক।
দেশে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে ৪৪ থেকে ৪৫ লাখ (১৬ শতাংশ) শ্রমিক বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে শ্রম দিয়ে থাকেন। রাসায়নিক ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ে কাজ করে থাকেন ৭ শতাংশ শ্রমিক। ৫ শতাংশ শ্রমিক কাজ করে থাকে আগুন ও গ্যাসযুক্ত পরিবেশে। এসব ছাড়াও মাটির নিচে বা অধিক উচ্চতায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে থাকে ৪ শতাংশ শ্রমিক। এছাড়াও আবহাওয়ার পরিবর্তনে টানা তাপদাহের মধ্যে খোলা মাঠে কাজ করা শ্রমিকরাও কাজ করছেন স্বাস্থ্য ঝুকি নিয়ে। যার সংখ্যাটাও অনেক। ২০২২ সালে জাতীয় পর্যায়ে মোট শ্রমিকের ২১ লাখের বেশি জন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা দিতে হবে। কিন্তু আশেপাশে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে শ্রমিকর সিংহভাগই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
শ্রম আইনে বলা আছে, শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কলকারখানা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, স্বাস্থ্যহানি না ঘটে সেজন্য পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ও যথাযথ তাপমাত্রা বজায় রাখতে হবে। পান করার জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা, মহিলা এবং পুরুষ শ্রমিকদের জন্য পৃথকভাবে শৌচাগার ও প্রক্ষালন কক্ষের ব্যবস্থা করা মালিকের দায়িত্ব। একই সঙ্গে শ্রমিকের ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো ভারী জিনিস উত্তোলন, বহন অথবা নাড়াচাড়া করতে না দেওয়া। কিন্তু বাস্তব চিত্রে এর বালাই নাই।
এছাড়া বিভিন্ন কল-কারখানায় অনেক শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসংস্থানে জড়িত রয়েছে। এটিও বেশ উদ্বেগের বিষয়। ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ প্রকাশ করে। সেখানে উঠে আসে দেশে ১০ লাখ ৬৮ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত আছে।
রিপোর্টে প্রকাশ পায়, শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন। শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজত শিশুর সংখ্যা ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জন।
২০২২ সালে আরো ৫টি কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে ৪৩টি কাজকে সরকার শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছেন। যেমন, অ্যানুমিনিয়ামের দ্রব্যদি তৈরি, অটো মোবাইল ওয়ার্কশপ, ব্যাটারি রি-চার্জিং, বিড়ি ও সিগারেট তৈরি, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ইট-পাথর ভাঙা, ম্যাচ তৈরি, প্লাষ্টিক, রাবার তৈরি, লবন শোধন, সাবান ডিটারজেন্ট তৈরি, স্টিলের ফার্নিচার, চামড়ার দ্রব্য তৈরি, ওয়েল্ডিং এর কাজ, কাপড়ের রং, জাহাজ ভাঙার কাজ, চামড়ার জুতো তৈরি, ভলকানাইজিং, মেটাল, জিআই শিট, চুনা পাথর বা চক সামগ্রী তৈরি, স্পিরিট, অ্যালকোহল, জর্দা, তামাকের কাজ, আবর্জনা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ ইত্যাদি। তবে, আশেপাশে দেখা যায় শিশুরা এসব কাজই বেশি করে থাকে।
শ্রমিকরা শতকষ্ট সহ্য করলেও মামলায় যেতে চান না। কোন কারণে শ্রম আদালতে মামলা হলে জনবল কাঠামোর ঘাটতি দেখিয়ে বছরের পর বছর পড়ে থাকে অমীমাংশিত মামলাগুলো। রাজশাহী শ্রম আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২৪ ফেব্রুয়ারি-২০২৪ পর্যন্ত ৯৫টি অভিযোগের মধ্যে ২টি নিষ্পত্তি হয়েছে।
রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব হোসেন চৌধুরী জানান, শ্রমিকরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করে। আমরা সবসময় শ্রমিকদের সামাজিক, আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার দাবি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আগামীতেও করবো। এজন্য মালিক পক্ষকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসতে হবে।
ইমারত নির্মান শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ (ইনসাব) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি নবাব আলী জানান, নির্মান শ্রমিকরা স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে খুবই ঝুঁকিতে থাকে। উঁচুতে কাজ করতে হয়। সেই সঙ্গে বালি, সিমেন্টের ধুলোয় কাজ করতে হয়। অনেক জায়গায় দেখা যায় যে শ্রমিকরা অনেক উঁচুতে কোন ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই কাজ করছে। এটা শ্রমিক একটি পরিবারের জীবিকা চালানোর চাকা। তাই মালিক-শ্রমিক উভয়কেই ভাবতে হবে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে।


প্রকাশিত: মে ১, ২০২৪ | সময়: ৪:১৬ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ