সর্বশেষ সংবাদ :

ছাত্রজীবন থেকেই ‘দাপুটে ও অস্ত্রবাজ’ রায়হান শরীফ

স্টাফ রিপোর্টার : শ্রেণিকক্ষে ছাত্রকে গুলি করার ঘটনায় গ্রেফতার সিরাজগঞ্জের এম. মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ডা. রায়হান শরীফ পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে (রামেক)। তিনি ছিলেন রামেক শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি। তিনি রামেক হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করেছেন। এ ছাড়া কিছুদিন গোদাগাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছিলেন। এসব হাসপাতালে তিনি অস্ত্র নিয়েই রোগী দেখতেন। অস্ত্র দেখিয়ে অনেককে ভয়ভীতিও দেখিয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি ছিলেন দাপুটে ও অস্ত্রবাজ। সে সময় শিবির দমনে তার অবদান ছিলো বলে ছাত্রলীগ তাকে প্রশ্রয় দিত। একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
রামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে তিনি রামেক হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করেন। ওই সময়ই তাঁর হাতে একাধিকবার আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। একাধিকবার তিনি অস্ত্র উঁচিয়েছেন রোগীর স্বজনদের দিকে। তবে কথায় কথায় ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ধর্মঘট কর্মসূচির কারণে জিম্মি হাসপাতাল কিংবা কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যদিও রায়হান শরীফের কারণে রামেক হাসপাতাল উত্তপ্ত হয়েছে বারবার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালে রামেক ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন শফিকুল ইসলাম অপু। আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কামাল হোসেন। তাদের কমিটিরই সহসভাপতি ছিলেন রায়হান শরীফ। রায়হান শরীফ সভাপতি শফিকুল ইসলামের অনুসারী ছিলেন। সে সময় রামেক হাসপাতাল ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ছিল ছাত্রলীগের হাতে। ছাত্রলীগ আর ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদ এক হয়ে হাসপাতালে কথায় কথায় রোগীর স্বজনদের পেটাত। ওই সময় ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের মুখপাত্রও ছিলেন ডা. রায়হান শরীফ।
অস্ত্রবাজ রায়হান ২০১৬ সালের ৬ নবেম্বর রামেক হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। সেদিন ওই ওয়ার্ডে জয় (১৮) নামের এক রোগী মারা যান। তখন রোগীর স্বজনেরা অভিযোগ করেন, জয়কে হাসপাতালে ভর্তির পর সেখানে কর্তব্যরত ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বারবার ডাকা হলেও কেউ যাননি।
বিনা চিকিৎসায় জয়ের মৃত্যুর পর স্বজনরা ইন্টার্ন চিকিৎসক ও রামেক ছাত্রলীগের সহসভাপতি রায়হান শরীফের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি তাদের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে অস্ত্র বের করেন। এরই মধ্যে ছাত্রলীগের আরও ১০-১২ জন নেতাকর্মী চলে আসেন। তারা রোগীর স্বজনদের জিম্মি করেন।
এর এক সপ্তাহ পর ১৩ নভেম্বর হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মহসিন আলী (৭৫) নামের এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে বিনা চিকিৎসায়। এ ওয়ার্ডে দায়িত্বে ছিলেন রামেক ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি শফিকুল ইসলাম অপু। মহসিনের মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে রফিকুল ইসলাম (৪০) ও আনারুল ইসলাম (৩০) হাসপাতালে আহাজারির সঙ্গে চিকিৎসকদের অভিশাপ দেন।
এ সময় শফিকুল ইসলাম অপু এই রায়হান শরীফসহ আরও ১০-১২ জন ইন্টার্ন চিকিৎসককে ফোন করে ডাকেন। রায়হান শরীফ সেদিনও দুই ভাইয়ের দিকে অস্ত্র তাক করেন। এ সময় তাদের মা রহিমা বিবি (৬৫) দুই ছেলের মাঝে দাঁড়িয়ে যান। পরে দুই ভাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সেদিন পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
পরে সামাজিক সংগঠন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে রহিমা বিবি বলেছিলেন, ‘একজন ইন্টার্নির হাতে পিস্তল ছিল। সে আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তখন ছেলেরা বলছে-‘মারেন, বাপরে মারলেন, আমরাকেও মারেন।’ ’পরে গুলি না করে আমার ছেলেদের পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তাদের পুলিশে দেওয়া হয়। তাদের বাবার লাশ মর্গে পড়ে থাকে।’
এই ঘটনার দুই দিন পর ১৫ নবেম্বর হাসপাতালের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে নাহিদ হোসেন (২৬) ও সাদ্দাম হোসেন (৩০) নামে রোগীর দুই স্বজনকে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখমের পর পুলিশের হাতে তুলে দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। ভর্তির একদিন পরও রোগী জয়নাল হোসেনের (৭০) চিকিৎসা হচ্ছিল না বলে সেদিন ওই দুজন ওয়ার্ডের ইন্টার্ন চিকিৎসক ও ছাত্রলীগকর্মী কেএম সালাউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। এ সময় তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে তাদের মারধর করা হয়। সেদিনও সালাউদ্দিনের পক্ষে ওয়ার্ডে গিয়ে দুজনকে মারধর করেন রায়হান শরীফ।
রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রায়হান শরীফ ছাত্রজীবনেই একটা মেশিন (অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র) সংগ্রহ করে কাছে রাখত। ওই সময় শিবির দমনে তার অবদান ছিল। সে কারণে ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতাদের সুনজরে থাকত। রায়হানের সাহসে সে সময় ইন্টার্ন চিকিৎসকেরাও খুব বেপরোয়া ছিল। কয়েক দিন পরপরই রোগীর স্বজনদের সঙ্গে ঝামেলা হতো। রায়হান অস্ত্র দেখিয়ে বেড়াত। কলেজেও তখন শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং ছিল। ছাত্রলীগের এই গ্রুপটা প্রভাবশালী এক চিকিৎসক ও শিক্ষককে সমর্থন দিত। তাই হাসপাতালে যত ঝামেলা হতো ওই শিক্ষকই সব ম্যানেজ করতেন।’
রামেক ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন এখন সরকারি চাকরিজীবী। তিনি বলেন, ‘রায়হান ভাই আমার এক ব্যাচ সিনিয়র ছিলেন। তাই আমি বেশি কিছু জানি না। তবে সংগঠন করতে গেলে অনেক কিছুই রাখা লাগে। তিনি একটু পাগলাটে-রগচটা টাইপের ছিলেন। পার্টি টাইমে মজা-মাস্তি করতেন। পরে বিসিএস দিয়ে তো স্বাভাবিক হচ্ছিলেন।
রামেক ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি শফিকুল ইসলাম অপু বলেন, ‘রায়হান শরীফ ছাত্রলীগের জন্য নিবেদিত ছিল। ছাত্রজীবনে সবারই কিছু না কিছু ঘটনা থাকে। পরে তো রায়হান বিসিএস ক্যাডার হলো। বিয়েও করেছিল। পরে বিয়েটা ডিভোর্স হয়ে যায়। অনেক দিন তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই।
রায়হান শরীফ ২০২১ সালে বিশেষ বিসিএস দিয়ে সিরাজগঞ্জের এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক হন। সেখানে শুরু থেকেই তিনি অস্ত্র দেখিয়ে বেড়াতেন। প্রকাশ্যেই চলাফেরা করতেন অস্ত্র নিয়ে। গত সোমবার শ্রেণিকক্ষে তিনি আরাফাত আমিন তমাল (২২) নামের এক ছাত্রকে গুলি করেন। মঙ্গলবার তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।


প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২৪ | সময়: ৬:২২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর