সর্বশেষ সংবাদ :

নেপথ্যে হরেক কারণ দেখছেন সচেতন নাগরিকরা : ভোটের লাইনে নজর কেড়েছে আদিবাসী নারীদের আধিক্য

সবনাজ মোস্তারী স্মৃতি : এবারের ভোটে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গেছেন রাজশাহীর আদিবাসী নারীরা। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো শীতের সকাল থেকে দলে দলে উৎসবের আমেজে দল বেঁধে ভোট দিয়েছেন তারা। এ জনগোষ্ঠীর নবীন কিংবা প্রবীন প্রায় সবাই সামিল ছিলেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধিকার প্রয়োগের এ কাতারে। ফলে ভোটের লাইনে আদিবাসী নারীদের আধিক্য নজর কেড়েছে নগরবাসীর। রোববার জেলার (রাজশাহী-১) সদর আসনের আদিবাসী ভোটার অধ্যুষিত বিভিন্ন কেন্দ্র সরেজমিনে ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
একাধিক ভোটকেন্দ্রের আশপাশের এলকায় পৃথক পৃথক আলাপচারিতায় আদিবাসী নারীরা বৈষম্য আর বঞ্চনার হরেক তথ্য তুলে ধরেছেন অকপটে। ভোট দেওয়া নিয়ে তাদের আগ্রহ ও উদ্দীপণার নেপথ্য থাকা শঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন নিচু স্বরে। জানিয়েছেন, দীর্ঘ আন্দলোন সংগ্রামে এ অবধি পাওয়া সুবিধা বহাল রাখা এবং ‘বঞ্চিত’ অধিকার প্রতিষ্ঠায় যোগ্য ব্যািক্তকে বাছাই করতেই তাদের স্বপ্রনোদিত ভোট দেওয়ার এ উদ্যোগের কথা। বলেছেন, ”যুগযুগ ধরে নানান বঞ্চনা আমাদের অধিকার স্বচেতন করে তুলেছে। কারো হুমকি, ধামকি বা লালোসায় নয়, নতুন স্বপ্নে বাঁচার তাগিদে ভোট দিয়েছি।”
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্য ভান্ডার অনুযায়ী, মূলতঃ রাজশাহী জেলা ও তার আশপাশ ঘিরেই আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস। তবে আদিবাসী জনসংখ্যা ও ভোটের হিসেবে সব চেয়ে এগিয়ে রাজশাহী -১ (তানোর –- গোদাগাড়ী) সংসদীয় আসন। এ দুই উপজেলাতে রয়েছেন ৬৩ হাজার আদিবাসী ভোটার। পুরুষ আর নারী ভোটারের সংখ্যা প্রায় সমানে সমান। এর মধ্যে এ আসনের ভোটার তালিকায় যোগ হয়েছে আদিবাসীদের তিন হাজারের বেশি নতুন ভোট। যার অর্ধেকই নারী ভোটার।
নির্বাচন কমিশন কিংবা রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে পৃথক কোনো তথ্য উপাত্য না থাকলেও আদিবাসী সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, এবারের ভোটে প্রায় ২৫ হাজার আদিবাসী নারী ভোট দিয়েছেন। যা দশম কিংবা একাদ্বশ নির্বাচনে দেওয়া মোট ভোটের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন। আর এসব ভোটারদের ভোট উৎসব দেখতে সরেজমিনে ঘুরে ঘণ শ্যামপুর, কামার গা, আইআই স্কুল, কাপাশিয়া পাড়া, সরণজাই স্কুল, ঈশ্বরীপুর প্রাইমারি স্কুল ও পাঁচন্দর প্রাইমারি স্কুল ভোটকেন্দ্রের আদিবাসী নারী ভোটারদের সঙ্গে।
”কারো আদেশ নির্দেশে নয়, যোগ্য প্রার্থীকে জেতাতে ভোট দিয়েছি। শেখ হাসিনা জিতলে আমরাই জিতবো। হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে বয়স্ক ভাতাসহ নতুন নতুন সুযোগ সুবিধা পাবো। সেই জন্য রোদ ওঠার আগে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে শুরুতেই ভোট দিয়েছি।”- ঈশ্বরীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের অদূরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো অকপটে বলছিলেন নবাই বটতলার ষাটউর্ধ্ব নেপালি এক্কা। পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়িয়ে নেপালি এক্কার কথায় সায় দিচ্ছিলেন একই গ্রামের আদিবাসী নারী ভোটার মারিয়া টপ্পো (৫৫),সুমি হেম্ব্রম (৬২), রিনা সরেন (৬৫), মিনতি টুডু (৬১), গৃহবধূ লিপি মুর্মু (২৮), লিলি হাঁসদা (২৫)। দুই কিলোমিটার ভ্যানে চড়ে দল বেধে কেন্দ্রে এসেছিলেন এরা সবাই।
এবারের ভোটার হয়েছেন কল্পনা টুডু। জীবনে প্রথমবার ভোট দিয়ে ভিন্ন মাত্রার উচ্ছাসের মিশেলে টুডু বলেন, “শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে হাসিনা সরকারের উপবৃত্তি পেয়েছি। তাঁর কারণেই এক সময়ের অনগ্রসর আদিবাসী পরিবারের সন্তানরা এখন স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। তবে আমাদের সমাজে বহাল বাল্যবিবাহ বন্ধে নতুন সরকার কিছু একটা করলে আমার মত মেয়েরা অনেক দূর এগুতে পারবো- সেই স্বপ্ন নিয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার ভোট দিয়েছি।”
ভিন্ন কথা বলেছেন বয়সের হিসেবে দুই যুগ ছোঁয়া মন্ডুমালা গ্রামের রিনা টুডু। স্বউৎসাহে ভ্যানে চড়ে তিন কিলোমিটার পথ ডিঙ্গিয়ে পাঁচন্দর প্রাইমারি স্কুল কেন্দ্রে ভোটদান শেষে এনজিও কর্মী রিনা টুডু বললেন, “যারা ইউনিয়নে বসবাস করছেন তারা প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বাড়ি, ভাতা, ত্রানসহ সব সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু পৌরসভা এলাকায় থাকার কারণে আমরা কিছুই পাচ্ছি না। তবে আগামীতে অন্যদেরমত আমাদেরও সকল সুযোগ সুবিধা দেওয়ার আশ্বাসে ভালো প্রার্থীকে ভোট দিয়েছি।” রিনা টুটুর পাশে দাঁড়িয়ে অপর আদিবাসী নারী ভোটার মন্ডুমালা গ্রামের পানি সংকট উল্লেখ করে নতুন জনপ্রতিনিধি তা দূরকরতে ভুমিকা নেবেন আশায় ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
আদিবাসীদের অধিকার আদায় আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী মানিক সরেনের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমেই আদিবাসীদের বেশ কিছু অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। উচ্চ শিক্ষা আর কর্ম সংস্থানেরমত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতেও শিগিরই উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি আদিবাসী ভোটার তথা নারীদের মাঝে নতুন স্বপ্ন দেখা দিয়েছে। তাই ভোটের বিষয়ে আদিবাসী নারীদের আগ্রহ উচ্ছাস অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এবার বেশি দেখা গেছে। পাড়া মহল্লা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দশম ও একাদ্বশ নির্বাচনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন সংখ্যক আদিবাসী নারী এবার ভোট দিয়েছেন।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুভাষচন্দ্র হেমব্রম বলেন , নিজেদের অধিকার আদায়ে আদিবাসীরা দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম করে চলেছেন। সে কারণে সকল পর্যায়ের আদিবাসী নারী পুরুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় অন্য ধর্ম বর্ণের তুলনায় আদিবাসী নারীরা নিজের অধিকার প্রয়োগে দিনের শুরু থেকেই ভোট কেন্দ্রে গিয়ে স্বউৎসাহে ভোট দিয়েছেন।
সমাজ বিশ্লেষক সুব্রত পাল বলছেন, আদিবাসীদের সব থেকে বেশি বসবাস গোদাগাড়ী ও তানোরে। এ এলাকার আদিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়নে রাজনৈতিক নেতারা কাজ করেছেন। এ কারণে আদিবাসীদের মাঝে ভোট দেওয়ার আগ্রহ বেশি হোতে পারে। আবার ভোট না দিলে টিসিবির পণ্য সরবরাহ বন্ধ বা টিসিবির সুবিধা ভোগিদের তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ার ভয় থেকেও আদিবাসীদের উপস্থিতি বেশি হোতে পারে। পরনির্ভশীল মানষিকতাও ভোটকেন্দ্রে তাদের বেশি উপস্থিতির অন্যতম কারণ।
আদিবাসীদের নিয়ে গবেষনা করছেন খ্যাতিমান গবেষক শহিদুল ইসলাম। তার মতে আদিবাসীরা শান্তি প্রিয়। এবারের নির্বাচনে কোথাও তেমন বিশৃঙ্খলা না হওয়ায় বেশি সংখ্যক আদিবাসী শঙ্কাহীনভাবে ভোট দিয়েছেন। এ ছাড়া তাদের মধ্যে আগের তুলনায় সচেতনতাও বেড়েছে অনেক। অধিকার সচেতনতাও আদিবাসীদেও ভোটের লাইনকে দীর্ঘ করেছে বলে মনে করেন এই গবেষক।
রাজশাহী বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম কমিউনিকেশন এ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের এডজাংক্ট ফ্যাকাল্টির আরআইএম গোলাম রাব্বানী বলেন,স্বাধীনতার পর থেকে এই আসনে নারী পার্থী ছিলো না বললেই চলে।তবে এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-১ আসনে তিনজন নারী পার্থী রয়েছেন।এদের মাঝে একজন চিত্রনায়িকা। নারী পার্থীরা এবার সব থেকে বেশি জনসংযোগ করেছেন আদিবাসী এলাকাগুলোতে। আর তাই আদিবাসী নারী ভোটারটা সব থেকে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ডীন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. একরাম উল্লাহ মনে করেন, শুধুমাত্র আদিবাসী নয়, হিšদু সম্প্রদায়ের ভোটাররাও বিশ^াস করেন আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে তারা বেশি সুবিধা পাবেন। দেশ থেকে অসাম্প্রদায়িকতা দূর হবে। আর তাই তারা আবার শেখ হাসিনার পক্ষে রায় দিতে দল বেঁধে ভোট দিতে গিয়েছিলেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহীর সভাপতি সফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এবারের পার্থীরা আদিবাসী ভোট ব্যাংকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে গনসংযোগ করেছেন। বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যার সমাধান আর নতুন নতুন সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন। হরেক ছকে তাদের ভোট কেন্দ্রে যেতে উদ্ভুদ্ধ করেছেন । এসব কারণে ভোটকেন্দ্রে আদিবাসীদের উপস্থিতি অতিতের সব রেকর্ড ভেঙ্গেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।


প্রকাশিত: জানুয়ারি ১০, ২০২৪ | সময়: ৭:২২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ