বিজয়ের মাস ডিসেম্বর

সানশাইন ডেস্ক : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতের পর থেকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, ডিসেম্বরে তা নতুন মাত্রা লাভ করে।
নভেম্বরের প্রথম দিকে বিবিসি’র খবরে বলা হয়েছিল-ঢাকা শহর ঘিরে রেখেছে আট হাজার মুক্তিবাহিনী। তারা বিচ্ছিন্নভাবে ঘেরাও তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু যেকোনও সময় একসঙ্গে শহরের প্রবেশ করবে। গেরিলা নীতিতে বেছে নিতে হয় শত্রুর দুর্বলতম অংশ। সে ক্ষেত্রে শত্রুর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি রাজধানী শেষ লক্ষ্যস্থল হওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকা শহরে যেসব আক্রমণ চালানো হয়-তার উদ্দেশ্য সামরিক কৌশলগত আধিপত্য ছিল না, উদ্দেশ্যটা ছিল মূলত বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া, মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করছে এবং সহজেই আঘাত হানছে।
১৯৭২ সালে তৎকালীন দৈনিক বাংলা পত্রিকায় মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত চৌধুরীর লেখা কলামে এসব তথ্য উঠে আসে। তিনি লিখেছেন, ‘এ সম্পর্কে খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন অধিনায়ক। শহরে যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। শত্রুকে শুধু জানিয়ে দাও-তোমরা আছো। দুই নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্সের অধিনায়ক কর্নেল খালেদ মোশাররফ সবসময় বলতেন গেরিলাদের উদ্দেশ্য নিয়ে। একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার কয়েকটি দুঃসাহসিক গেরিলা প্লাটুনকে প্রত্যাহার করা হয়। কারণ, এদের কিছু যোদ্ধা ধরা পড়েন শত্রুর হাতে। তখন কর্নেল খালেদ বলেছিলেন, কাউ-বয় অ্যাডভেঞ্চার গেরিলা যুদ্ধ নয়, গেরিলা যুদ্ধ দেখাবার জন্য নয়।’
আবার এসেছে সেই বিজয়ের মাস। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তার মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির হাজার বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্ন পূরণ হয় এ মাসে। ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার স্বাক্ষর বিজয়ের মাস নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হবে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ, আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর জল-স্থল আর আকাশপথে সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের সংবাদ চারদিক থেকে আসতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সেখানেই পরাজয়ের দলিলে সই করেন পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, কীভাবে তারা সেই সময় মনোবল ধরে রেখেছিলেন এবং যুদ্ধের গতি বলছিল—আর বেশি দিন নেই, জয় সুনিশ্চিত। আসলেই কি তেমন ছিল পরিস্থিতি? জানতে চাইলে তারা বলছেন, ততদিনে স্পষ্ট যে ভারত যুক্ত হতে চলেছে। আমরা খোঁজ পাচ্ছিলাম। যুদ্ধের সময়জুড়ে বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে যে আলাপ, সেটি এই মাসে এসে পূরণ হতে যাচ্ছে—সেই আভাসও ছিল বাতাসে। একইসঙ্গে বর্তমান সংকট নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হতে পারে, এমন কথা বলছিলেন বিশ্বনেতারা।
শাহাদাত চৌধুরী লেখেন, ‘নভেম্বর মাস থেকেই ঢাকাকে ঘিরে গেরিলারা তৎপরতা বৃদ্ধি করে। মানিক গ্রুপ সাভার অঞ্চলে আর এদিকে মানে ঢাকায় ক্র্যাকরা।’ তিনি পরিস্থিতির বিবরণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘পুরো রূপগঞ্জ থানা তখন গেরিলা ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। শীতলক্ষ্যার পার ধরে মিলগুলো ছিল আর্মি বাংকার। তারা গেরিলা আক্রমণে আস্তে আস্তে কেটে পড়ে।’
সে সময় লন্ডনে বসে যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ ও জনমত গঠনে কাজ করেছেন দেশের বেশ কিছু প্রগতিশীল অ্যাক্টিভিস্ট ও পেশাজীবী। তখন মূল কাজ ছিল বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া—কী ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধ চলছে বাংলাদেশে। এই জনমত গঠনের কাজে জড়িতদের অন্যতম ছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ডিসেম্বরের শুরুতে কী মনে হয়েছিল প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তখন বিশ্ব রাজনীতি স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে ইন্দিরা গান্ধী গেলেন লন্ডনে। সেখানে ভারতীয় ও বাঙালি মিলে কয়েক হাজার লোকের একটি সমাবেশের আয়োজন হয়েছিল। আমরা দূরে ছিলাম বটে, কিন্তু ডিসেম্বরে এসে বিশ্ব ঐকমত্য গঠনের কাজটি অনেক জরুরি ছিল। বিশ্ব মিডিয়া টাইমস, টেলিগ্রাফ, হেরাল্ড ট্রিবিউন, বিবিসিতে প্রকাশিত তথ্যাদি নিশ্চিত করছিল—মুক্তিযোদ্ধারা দেশে ঢুকে পড়েছে, একটার পর একটা অঞ্চল শত্রুমুক্ত করতে শুরু করেছে।’


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২, ২০২৩ | সময়: ৫:২২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ