জি এম কাদেরকে ‘অব্যাহতি’ দিয়ে ‘চেয়ার’ নিলেন রওশন

সানশাইন ডেস্ক: ভারত সফরে থাকা গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। দলের নেতৃত্ব নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে জাতীয় পার্টিতে নানা টানাপড়েনের মধ্যে এই ঘটনা ঘটল।
তবে যে বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়েছে, তার কোনো ‘ভিত্তি নেই’ বলে দাবি করেছেন দলের মহাসচিব ও জিএম কাদেরপন্থি নেতা মুজিবুল হক চুন্নু। অন্যদিকে সাবেক মহাসচিব ও রওশনপন্থি নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত না মানলে চুন্নুরা রাস্তায় নামতে পারেন। মঙ্গলবার রওশন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি, নানা ধরনের মামলা-মোকদ্দমা এবং দল পরিচালনায় ‘অযোগ্যতা ও অসাংগঠনিক আচরণের কারণে’ জিএম কাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
সেখানে বলা হয়, জাতীয় পার্টির একাংশের মেয়াদোত্তীর্ণ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। রওশন লেখেন, ‘আমি বেগম রওশন এরশাদ, এমপি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান এই মর্মে ঘোষণা করছি যে পার্টির সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে ও সিদ্ধান্তক্রমে দলের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।’
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর তার ভাই জি এম কাদের ও স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদের মধ্যে দলের নেতৃত্ব নিয়ে টানাপড়েন দেখা দেয়। সে সময় জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান ও রওশনকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করে সামাল দেওয়া হয়। গত বছরের ৩১ অগাস্ট হঠাৎ করেই এক চিঠিতে দলের কাউন্সিল আহ্বান করেন রওশন। তবে জিএম কাদেরের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই পদক্ষেপ ‘অবৈধ’, কারণ, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল আহ্বানের ক্ষমতা আছে কেবল তার।
এরপর জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে আদালতেও মামলা করা হয়। দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের মধ্যে গত ১৩ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির দুই নেতা একসঙ্গে গিয়ে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সে সময় দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার কথাও জানানো হয়। গত কয়েক মাস ধরেই জি এম কাদের সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলের অবস্থান কী হবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট করছিলেন না তিনি।
১৯৯৯ সালে জাতীয় পার্টি বিএনপির সঙ্গে জোটে গেলেও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সে জোট থেকে বের হয়ে আসে। এ নিয়ে তখন দলে ভাঙন ধরে। বিজেপি নামে দল গঠন করে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটে থেকে যায় একটি অংশ। ২০০৬ সালে বিএনপিবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় জাতীয় পার্টি। ২০০৮ সালে জোটবদ্ধ হয়েই তারা যায় ভোটে।
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগে এরশাদ একেক সময় একেক অবস্থান নেন। তবে ভোটের আগে আগে তার অসুস্থতার কথা বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করে। বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একাংশ যায় ভোটে।
সে সময় জি এম কাদের তার ভাইয়ের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। এরশাদও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করেন। তবে নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ব্যালটে নাম নাম থেকে যায়। রংপুর সদর আসন থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন তিনি।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আবার আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে সমঝোতা হয়। আগের বার দুই দল একসঙ্গে সরকার গঠন করলেও এবার জাতীয় পার্টিকে আর মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়নি। আগামী জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কী করবে, এই আলোচনার মধ্যে গত ২০ আগস্ট ভারতের আমন্ত্রণে নয়াদিল্লি যান জি এম কাদের। এর আগের দিন গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন রওশন।
এর তিন দিন পরেই রওশনের দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিটি আসে। এতে জানানো হয়, আসন্ন দশম জাতীয় সম্মেলন পর্যন্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তিনি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের বেশিরভাগ সদস্য ও সংসদ সদস্যের মতামত এবং চারজন কো-চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে ‘চলমান ক্রান্তিকাল মোকাবিলায়’ রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়।
গত বছরের ৭ ডিসেম্বরের সেই সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, মামলা-মোকদ্দমায় জাতীয় পার্টির চলমান অচল অবস্থা নিরসনে পার্টির চারজন কো চেয়ারম্যান সংকট উত্তরণে বেগম রওশন এরশাদকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে পার্টির চার কো-চেয়ারম্যান ও দুজন প্রেসিডিয়াম সদস্য ‘ক্রান্তিকাল মোকাবিলায়’ রওশনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব অর্পণ করেন।
কো-চেয়ারম্যানরা হলেন এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও সালমা ইসলাম। প্রেসিডিয়াম সদস্যরা হলেন শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও নাছরিন জাহান রত্নী। জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও জি এম কাদেরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, “যাদের নাম দিয়ে, স্বাক্ষর দিয়ে তারা এটা করেছেন, তারা অনেকেই জানেই না।”
তার দাবি, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও কাজী ফিরোজ রশীদের এ বিষয়ে কিছু ধারণাই নেই। “এগুলো ভুয়া। স্বাক্ষর জালিয়াতি করে এমন করেছে, এগুলোর কোন ভিত্তি নেই”, বলেন তিনি। জাতীয় পার্টির আরেক কো-চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য সৈয়দ আবুল হোসেন বাবলাও বলেছেন, রওশনকে চেয়ারম্যান করার প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি কিছুই ‘জানেন না’। এক বিবৃতিতে রওশনকে চেয়ারম্যান হতে প্রস্তাবকারী হিসেবে তার নাম ব্যবহারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাবলা।
তিনি বলেন, “জি এম কাদের এমপি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে বহাল আছেন। আমরা তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছি।” রওশনের চেয়ারম্যান হওয়ার সংবাদে বিভ্রান্ত না হতে দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন বাবলা। তবে রওশন পন্থি বলে পরিচিত জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, “তারা না মানলে বলেন রাস্তায় নেমে আন্দোলন করুক।
“জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে মানবে না, এটা কোনো কথা? রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে বলেন”, এই বলে শেষ করেন রাঙ্গা। জাতীয় পার্টির কাউন্সিল নিয়ে গত বছরের অগাস্টে যখন বিবাদ দেখা দিয়েছিল, সে সময় রাঙ্গাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন জি এম কাদের।


প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০২৩ | সময়: ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ