শিবনদে সেতুর সংযোগ রাস্তার কাজ চলছে সতের বছর ধরে

টিপু সুলতান, তানোর: রাজশাহীর তানোরে শিব নদীর (বিলকুমারী বিল) ওপর নির্মিত সেতুর সংযোগ রাস্তা নির্মাণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। গত ১৭ বছর ধরে সেতু ও সংযোগ রাস্তার কাজ চলছে। কাজের নামে কয়েক ধাপে কোটি কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বদল করা হয়েছে কয়েকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে। তবুও সেতুর সংযোগ রাস্তার ঠিক হয়নি।
সংযোগ সড়কের ইটের ছোলিং রাস্তাটি কাজ শেষ হবার এক সপ্তাহের মধ্যে দুই ধারে ধসে যায়। রাস্তাটি ঠিক করতে আবারও নতুন করে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়। চলতি কাজের দায়িত্বে হোসেন এন্টার প্রাইজ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের আব্দুর রশিদের লোকজন গত ঈদের আগে তাড়াহুড়ো করে ভেঙ্গে যাওয়া সড়কে দুই ধারে ব্লক দিয়ে রাস্তা বেধে বালি ভর্তি বস্তা বসানো হয়। কাজ চলা অবস্থায় আবারো রাস্তা দেবে যায়।
গতকাল সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সংযোগ সড়কের দুই ধার ভেঙ্গে গেছে। রাস্তার অনেক স্থানে দেবে গিয়ে গত্তের সৃষ্ঠি হয়েছে।
তানোর উপজেলা এলজিইডি’র অফিস সুত্রে জানা গেছে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য বিগত জোট সরকারের সময় ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে তানোর-মোহনপুর শিব নদীর ওপর ২১০ মিটার সেতুটি নির্মাণ কাজ হাতে নেয়া হয়। সেতুটি নির্মাণ কাজের জন্য ওই সময় সরকার ৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকার বরাদ্দ দেয়। পত্রিকায় দরপত্রের মাধ্যমে মেসার্স মাইনুল এন্টার প্রাইজ কাজটি পাই। কার্যাদেশ প্রাপ্তির পর তৎকালীন জোট সরকারের ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিষ্টার আমিনুল হক ২০০৬ সালের ৪ই মার্চ সেতুটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
সেই সময়ের আকস্মিকভাবে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সেতুটির মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করে ২ কোটি টাকা উত্তোলন করে সেতুটির কাজ বন্ধ করে দেয়।
মন্ত্রানালয়ে একাধিকবার চিঠি লিখে গত ২০১০ সালের জুন মাসে নতুন করে আবারও পত্রিকায় দরপত্রের মাধ্যমে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে মেসার্স রানা বিলর্ডাস কাজের দায়িত্ব পায়। সেতুটির বাঁকি কাজ সরকারের বেধে দেয়া সময়ের মধ্যে শেষ হয়। সেতু নির্মাণ কাজ শেষে শুরু হয় সেতুর সংযোগ রাস্তার কাজ। ১৭ বছর ধরে চলছে শিব নদীর উপর নির্মিত সেতু ও সংযোগ রাস্তার কাজ।
তানোর গোল্লাপাড়া বাজারের বনিক সমিতির সভাপতি ও কাপড় ব্যবসায়ী সারোয়ার জাহান বলেন, শিব নদীর উপর দিয়ে নির্মিত সেতু ও সংযোগ রাস্তার কাজ শুরু হয়েছে প্রায় এক যুগের ও বেশি সময় আগে। বছরের পর বছর ধরে দেখি আসছি কাজ হচ্ছে। তবে কাজ শেষ হবে কবে জানি না। পরিকল্পনার ঠিক না থাকার কারণে এমন দশা হয়েছে।
তানোর বাজারের উত্তম সরকার ও প্রতাব সরকার বলেন, সংযোগ রাস্তার পেছনে যত টাকা ব্যায় হয়েছে সেই টাকা দিয়ে আরো একটি নতুন সেতু তৈরি করা যেত। বার বার অর্থ বাড়িয়ে কাজের নামে এলজিইডি অফিসের কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারদের পকেট ভারি হয়েছে। সেতুটি পূর্ণ ভাবে চালু না হওয়ার কারনে উন্নয়নের দিক থেকে তানোরবাসী বঞ্চিত হচ্ছে।
জানা গেছে, প্রায় ১ দশমিক ৪৫০ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণে প্রথমে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি ব্যয় ধরা হলেও দ্বিতীয়বার প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে এবং তৃতীয় বারে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। এভাবে প্রায় ১৭ বছরে ধাপে ধাপে বাড়ছে কোটি কোটি টাকা।
ব্যয় বাড়ানো হলেও সেতুর সংযোগ রাস্তার নির্মাণ কাজ এখানো সম্পন্ন হয়নি, আবার যতটুকু হয়েছিল সেটি ভেঙ্গে পড়েছে ফলে সেতু যন্ত্রণা কাটছেই না। ফলে ব্যয় বাড়ানোয় একদিকে সরকারের অর্থ গচ্চা যাচ্ছে, অন্যদিকে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পকেটভারী হচ্ছে।
আর এসব অর্থের মধ্যে থেকে একটি অংশ ঢুকছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের একশ্রেণীর দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তার পকেটে। যে কারণে তারা বিষয়টি দেখেও না দেখার অভিনয় করে এড়িয়ে যাচ্ছেন। বার বার বরাদ্দ বৃদ্ধি করছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
চলতি বছরে সেতু রক্ষায় বাঁধ নির্মাণে তিন কোটি এবং সংযোগ সড়ক নির্মাণে ২৫ লাখ টাকার প্রকল্প নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। চলতি বছরের ৩০ জুন প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শেষ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নির্মাণকাজ শেষের এক মাস না যেতেই আবারও ধসে পড়েছে সেতু রক্ষা বাঁধের ব্লক। তিন কোটি ২৫ লাখ টাকার বাঁধ ও সড়ক টিকল না এক মাসও।
এখন ভাঙাচোরা সড়ক দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহন ও মানুষ। সেতুটিও পড়েছে ঝুঁকিতে। স্থানীয়রা জানান, কিছুদিন আগে ব্লক ও বালু দিয়ে ভরাট করে সংযোগ সড়কটি এইচবিবি করা হলো। অথচ সেতুর পূর্ব দিকের সংযোগ সড়কের উত্তর পাশে একাধিক বিশাল আকারের ফাটল ধরেছে এবং ব্লক সরে যাচ্ছে।
তানোর উপজেলা প্রকৌশলী সাইদুর রহমান বলেন, নদীর মধ্যে মাটি নরম। দূর থেকে মাটি ভরাট করে ব্লক দিয়ে রাস্তার দুই ধার বাধা হলেও নদীর পারি বৃদ্ধির হবার পর রাস্তার দুই ধার ধ্বসে যাচ্ছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাস্তার ঠিক করে দিবে। ঠিকাদারের জামানত আছে। রাস্তা ঠিক করতে তাকে চিঠি দেয়া হবে।
তবে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার আবদুর রশিদ বলেন, ‘সেতুর পূর্ব দিকের সড়কে ব্লকের জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেটা আগের। বর্তমানে সবকিছুর দাম দ্বিগুণ। এতো ভাল করে কাজ কারার পরও রাস্তাটি টিকছেনা। কাজ করে আমাদের লছ হচ্ছে। শুধু এলজিইডি অফিসের বড় বড় স্যারদের কথা ফেলতে না পেরে কাজ করেছি।
তানোর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা বিল্ল্াল হোসেন বলেন, আমি নতুন এসেছি তানোরে। সেতুর সংযোগ সড়কের কাজ দীর্ঘ দিন থেকে চলছে বিষয়টি আমি শুনেছি। আমি বিষয়টি নিয়ে উপজেলা প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলবো।


প্রকাশিত: আগস্ট ৩, ২০২৩ | সময়: ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ