রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর মুসড়াপাড়া পুরুষশূন্য, বড়গাছীতে শোক

স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পাকড়ি ইউনিয়নের ইয়াজপুর গ্রামে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের হামলায় চারজন নিহত হয়েছেন। উপজেলার মুসরাপাড়া ও বড়গাছি কানপাড়া গ্রামের লোকজনের মাঝে সংঘর্ষের পর থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
এছাড়া মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য মুসরাপাড়া গ্রাম। স্বজন হারিয়ে বড়গাছি কানপাড়া গ্রামে চলছে শোকের মাতম।
স্থানীয়রা জানান, জমি নিয়ে স্থানীয় সেলিম রেজা ও আসিফ আলী চাঁদের লোকজনের মধ্যে বিরোধ ছিল। সোমবার (১০ জুলাই) সকালে জমিতে সেলিমের লোকজন ধান লাগাতে গেলে আসিফ আলীর লোকজন হামলা চালায়। এতে অন্তত ১০ জন আহত হন। তাদের মধ্য দুজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। আর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুজনের মৃত্যু হয়।
নিহতরা হলেন গোদাগাড়ী উপজেলার ভাটাপাড়া গ্রামের জিল্লুর রহমানের ছেলে ছোটন (৫০), বড়গাছি কানপাড়া গ্রামের নাইমুল ইসলাম (৮০) ও তার ভাই মেহের আলী (৭০) এবং উপজেলার গোসিরা এলাকার আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে মনিরুল ইসলাম (৪৫)।
সরেজমিনে মঙ্গলবার (১১ জুলাই) ইয়াজপুর, মুসরাপাড়া, বড়গাছি কানপাড়া গ্রাম ঘুরে দেখো গেছে, দুপক্ষের সংঘর্ষের কারণে এলাকায় সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। এক গ্রামে চলছে শোকের মাতম। অন্য গ্রাম পুরুষশূন্য।
ইয়াজপুর মাঠের ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা গেছে, জমিগুলো ধান লাগানোর জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। তবে কোনো জমিতেই ধান লাগানো হয়নি। একবারে শুরুর দিকে মাঠে নামতেই পড়ে থাকতে দেখা গেলো বাঁশের লাঠি। একটু এগোতেই জমির আইলে চোখে পড়ছে রক্তের ছাপ। মূল জমিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শুধু রক্ত আর রক্ত। পড়ে আছে লাঠিও। একটু নিচে যেতেই দেখা মিললো গেঞ্জি ও গামছার। পাশেই পড়ে আছে একটি স্যান্ডেলও।
সংঘর্ষের পর থেকে পাশের জমিতেও নামার সাহস পাচ্ছেন না কৃষকরা। চাষি সোহেল রানা তার জমি দেখিয়ে বলেন, আমার জমি প্রস্তুত। কিন্তু আমার পাশের জমিতেই মারামারি হয়েছে। এজন্য কাল থেকে ধান লাগানোর কথা থাকলেও তা করা যায়নি। মাঠে তেমন কেউ নামছে না। সবাই অনেক আতঙ্কিত। মাঠজুড়েই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আবারও কেউ যদি হামলা করে তাই ভয়ে অনেকেই মাঠে নামছে না।
জমি নিয়ে গোদাগাড়ীর মুসরাপাড়া ও বড়গাছি কানপাড়ার মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে বড়গাছি কানপাড়ার আপন দুই ভাইসহ মোট চারজন নিহত হন। এ ঘটনার পর থেকেই পুরুষশূন্য মুসরাপাড়া। সকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামের কোনো বাড়িতেই নেই পুরুষ। কেবল নারী ও শিশুদের দেখা মিলেছে। গ্রামের দোকানপাটও বন্ধ।
মুসড়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্র বললো, ওই মাঠে মারামারির কারণে মানুষ মারা গেছে। তাই আমাদের পাড়ার কেউ নেই। এজন্য সব দোকানও বন্ধ।
সন্তান কোলে নিয়ে হাঁটছিলেন শেফালি বেগম। তিনি বলেন, নিরপরাধ লোকজনকেও পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে। তাই বাড়িতে কেউ থাকছে না। আমাদের তো একটা পরিবার আছে। যারা দোষ করেছে তাদের নিয়ে যাক। এখন আমরা নিরাপত্তাহীনতায় আছি। আমাদের তো কোনো দোষ নেই। তাহলে আমাদের বাড়ির সবাইকে কেন পালিয়ে থাকতে হচ্ছে।
জমি নিয়ে বিরোধের জেরে সংঘর্ষে কানপাড়া গ্রামের নাইমুল ইসলাম ও তার ভাই মেহের আলী নিহত হয়েছেন। দুই ভাইয়ের মৃত্যুতে শোকের মাতম চলছে কানপাড়ায়। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত গ্রামে মরদেহ পৌঁছায়নি। তবে মরদেহ গোসলের জন্য উঠানে রাখা হয়েছে দুটি খাট ও মরদেহ বহনের জন্য খাটিয়া।
বাড়ির ভেতর বাইরে চলছে স্বজনদের আহাজারি। সেখানেই কথা হয় নাইমুলের ভাতিজা নাসিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার চাচা জমিটি বর্গাচাষ করতেন। জমি নিয়ে বিরোধে পিটিয়ে মারা হয়েছে তাদের। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
কান্না করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মেহেরের মেয়ে সোহাগী খাতুন। তিনি বলেন, আমরা এর সুবিচার চাই। আমার বাবা-চাচা মারা গেছে। আমার ভাইরা আহত। আমার এখন একটাই কথা তাদের শাস্তি চাই।


প্রকাশিত: জুলাই ১২, ২০২৩ | সময়: ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ