সুদ কারবারীর চাপে বালু ব্যবসায়ীর আত্মহত্যার অভিযোগ পরিবারের

কেশরহাট প্রতিনিধি: রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার কেশরহাটে সুদ কারবারিদের চাপ সহ্য করতে না পেরে ইব্রাহীম কারিগর (৬১) নামে এক ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেছেন। সুদের উপর ২ লাখ টাকা নেয়াই কাল হয়ে দাঁড়ায় ইব্রাহিম কারিগরের। যা কয়েক বছরে চড়া সুদে আসলে বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ লাখ টাকা। যা পরিশোধে স্থাবর অস্থাবর সহায় সম্পদ সব লিখে দেয়ার অমানবিক চাপে অতিষ্ট হয়ে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
গত বুধবার সকালে নিজ বাড়ি থেকে কয়েক মিটার দূরে মেয়ে জামাইয়ের নির্মানাধীন ভবনে ইব্রাহীম কারিগরের ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়। লাশ উদ্ধারের পর প্রাথমিকভাবে এটি আত্মহত্যা বলে ধারণা করে থানা পুলিশ। পুলিশের ধারণা মতে, দেনার চাপে পরে ইব্রাহীম কারিগর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। নিহত ইব্রাহীম কারিগর উপজেলার কেশরহাট পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাকশৈল গ্রামের তমির কারিগরের ছেলে।
কেশরহাট বাজার পেট্রল পাম্পের পাশে দীর্ঘদিন ধরে তার ইট- বালির ব্যবসা রয়েছে। পরিবার থেকে জানা যায়, গত ৩০ এপ্রিল থেকে দুদিন নিখোঁজ ছিলেন ইব্রাহীম কারিগর।
সরেজমিনে জানা যায়, নিহত ইব্রাহীম কারিগরের লাশ দাফনের পরদিন সকালে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখলের চেষ্টা করে প্রতিবেশি একই গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে এলাকার চিহ্নিত অন্যতম সুদের কারবারী সাইফুল ইসলাম। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান পৌর মেয়র, থানা পুলিমসহ স্থানীয়রা। স্থানীয়দের বাধায় সাইফুল ইসলামের দখল চেষ্টা বিফলে যায়।
ঘটনাস্থলে সাইফুল ইসলাম জানান, নিহত ইব্রাহীম কারিগরের কাছে তার ১৪ লক্ষ টাকা পাওনা রয়েছে। তবে টাকা দেয়ার সঠিক কারণ এ প্রতিবেদককে জানাতে পারেননি তিনি। সাইফুল ইসলামের কথায় সন্দেহ বসত অনুসন্ধানে নেমে ইব্রাহীম কারিগরের আত্মহত্যার কারণ জানা যায়। পরিবার, প্রতিবেশী ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সুদে কারবারী সাইফুল ইসলামের দেনার চাপে পড়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ইব্রাহীম কারিগর। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এ তথ্য আরো অধিক নিশ্চিত হওয়া যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিগত কয়েক বছর পূর্বে ২০১৪ সালের দিকে সুদ কারবারী সাইফুল ইসলামের কাছে সুদের উপর ২ লক্ষ টাকা ঋণ নেয় ইব্রাহীম কারিগর। এরপর ব্যবসায়ীক মন্দার কারণে কয়েক বছরের ব্যবধানে তা সুদে আসলে বেড়ে দাড়াঁয় ১৪ লক্ষ টাকা। দেনার টাকা পরিশোধ করতে না পারায় গত কয়েকদিন আগে নিহত ইব্রাহীম কারিগরের ব্যবসায় ব্যবহৃত অন্তত বিশ লাখ টাকা সম-মূল্যের ২ টা ট্রলি, ২ টা কাঁকড়া, দোকানের চাবি ও খাতাপত্র জোড় করে কেঁড়ে নেয়ার পাশাপাশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্থাবর-অস্থাবর সকল কিছু স্ট্যাম্পে লিখে দিতে চাপ দেন সুদে কারবারী সাইফুল ইসলাম।
গত রবিবার ইব্রাহীম কারিগরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্থাবর-অস্থাবর স্ট্যাম্পে লিখে দেয়ার দিন নির্ধারণ হয়। সে অনুযায়ী গত রবিবার সকাল থেকেই ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করতে থাকে সাইফুল ইসলাম।
নিহত ইব্রাহীম কারিগরের পরিবারের অভিযোগ, এদিন সকাল থেকে ইব্রাহীম কারিগর দোকানে গেলে সেখানে থাকা সাইফুলের সাথে বাকবিতন্ডা তৈরি হয়। তখন সেখান থেকে বাড়িতে চলে আসেন। একপর্যায়ে দুপুরে ভাত খেয়ে উঠে বাড়ির বাইরে চলে যান ইব্রাহীম কারিগর। এরপর থেকে নিখোঁজ হন তিনি। পরিবার সূত্রে আরো জানা গেছে, সুদে কারবারী সাইফুল ইসলাম ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি এনজিওতে কয়েক লক্ষ টাকা দেনা রয়েছে নিহত ইব্রাহীম কারিগরের। পরিবারের দাবি, তিনি বেঁচে থাকলে ধিরেধিরে এসব দেনা পরিশোধ করতে পারতেন। কিন্তু তাকে সে সুযোগ না দিয়ে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করায় তিনি নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। একাধারে ফোন করার পাশাপাশি কথিত পুলিশ দিয়েও ফোনে ভয় দেখান সাইফুল ইসলাম।
নিহত ইব্রাহীম কারিগরের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন পর্যালোচনা করলে চাপ প্রয়োগের বিষয়টি খোলাসা হবে এমন দাবি পরিবারের বড় মেয়ে সাকিলার। সাকিলা খাতুন জানান, সাইফুল আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। সে আমার বাবার সিমেন্টের ব্যবসা চারটা গাড়িসহ সবকিছু ছিনিয়ে নেয়। আর সেগুলে বৈধ করতে স্ট্যাম্পে লিখে নেয়ার জন্য চাপ দেয় ও ভয়ভীতি দেখাতে থাকে।
একারণে আমার বাবা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। আমরা আমার বাবার সবকিছু ফিরে পেতে চাই। পাশাপাশি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। এদিন বিচারের দাবি নিয়ে থানা পুরিশের স্বরণাপূর্ণ হন পরিবারটি।
নিহত ইব্রাহিম কারিগরের ছোট ভাই নমির কারিগর জানান, সুদের কারবারি সাইফুল ইসলামের অমানবিক চাপে আমার বড় ভাই আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। একই গ্রামের প্রতিবেশী ও প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল মালেক বাবুল বলেন, গত রবিবার সকালে আমার সামনে সাইফুল ও ইব্রাহিমের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এসময় আমি ইব্রাহিমের সাথে কথা বলে জানতে পারি, সাইফুল চারটি গাড়িসহ দোকানের ইট বালু সবকিছু লিখে দেয়ার জন্য ব্যপকভাবে চাপ দিচ্ছে। এমনকি আমার সামনেই সাইফুল ইব্রাহিমকে বলে, সবকিছু লিখে দে।
তখন ইব্রাহিম বলে, আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া কোন উপায় নেয়। তখন সাইফুল বলে তুই আত্মহত্যা করবি না কি করবি জানিনা। তবে আজ সন্ধার মধ্যে আমাকে সবকিছু লিখে দিতে হবে। একথা শুনার পর বাবুল সেখান থেকে নিজের দোকানে চলে যান।
এদিকে, এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা? জানতে চাইলে মোহনপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সেলিম বাদশাহ জানান, ইব্রাহীম কারিগর একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সেই টাকা পরিশোধ না করায় তারা তাকে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করেন। এতে অভিমান করে তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
তিনি আরও জানান, এ বিষয়ে থানায় অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে নিহতের পরিবার চাইলে মামলা দায়ের করতে পারেন। তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


প্রকাশিত: মে ৭, ২০২৩ | সময়: ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ