রাজশাহীতে ভারতীয় মেডিকেল ভিসা আবেদনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের অর্ধেকই ভুয়া, ২ সদস্য আটক

স্টাফ রিপোর্টার : 

ভারতে চিকিৎসার জন্য রাজশাহীতে ভিসার আবেদনকারীদের অর্ধেকেরই মেডিকেল অ্যাপয়েন্টমেন্টের কাগজপত্র ভুয়া পাওয়া যাচ্ছে। এ ঘটনার সঙ্গে বাইরের দালালদের পাশাপাশি ভারতীয় ভিসা অফিসের কর্মকর্তাদেরও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

 

 

এই প্রতারণার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র (আইভিএসি), বগুড়ার ইনচার্জ নাফিস আহমেদ ও নিরাপত্তা প্রহরী বেলাল আলীকে সাময়িকভাবে বহিস্কার করা হয়েছে। এছাড়া জাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার তৈরির অভিযোগে শেখ মো. এনামুল হাসান তাসিন (২০) ও মো. রায়হান কবির (২১) নামে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। এনামুল রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া থানার শিরোইল মাস্টারপাড়ার শেখ মো. আবু সাঈদের ছেলে ও রায়হান কর্ণহার থানার শিশাপাড়ার মো. ইসরাইলের ছেলে। এসময় তাদের কাছ থেকে একটি কম্পিউটার, কালার প্রিন্টার ও স্ক্যানার উদ্ধার হয়েছে।

 

 

 

 

সূত্রে জানা যায়, ভুয়া মেডিকেল অ্যাপয়েন্টমেন্টের কাগজপত্র দিয়ে ভিসা নিয়ে ভারতে গিয়ে অনেক রোগী বিপাকে পড়েছেন। আবার অনেকেই ভারতে ভ্রমণে যাওয়ার জন্য সহজে ভিসা পাওয়ার কৌশল হিসেবে এই পদ্ধতিতে আবেদন করেন। রাজশাহীস্থ ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয় থেকে যাচাই করতে গিয়ে এই ধরনের ভুয়া মেডিকেল অ্যাপয়েন্টমেন্টের কাগজ পাওয়া গেছে। এই কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বগুড়া ভিসা অফিসের ভিসা নির্বাহী সবিতা আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মঙ্গলবার রাজশাহীস্থ সহকারী কমিশনারের কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। একজন মক্কেলের সঙ্গে তার ফোনালাপের রেকর্ড বাজিয়ে তাকে শোনানো হলে তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি এই ফোনালাপ করেছেন। সেখানে তাকে ভিসার দরদাম করতে শোনা যায়। তবে তিনি দাবি করেন তিনি ওই ব্যক্তির সঙ্গে একদিনই শুধু কথা বলেছেন।

 

 

সহকারী কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তারা দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে নমুনা (রেনডম স্যামপ্লিং) হিসেবে ১০০টি মেডিকেল ভিসার আবেদনকারী কাগজপত্র যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে, ৫০ জন আবেদনকারীই জাল মেডিকেল অ্যাপয়েন্টমেন্ট ব্যবহার করেছেন।

 

 

 

এরকম আবেদনকারীদের মধ্যে দেখা যায়, আকমল উদ্দিন দুলু নামের এক ব্যক্তি ভারতের ভেলরের খ্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে আবেদন করেছেন। এতে তার চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাতের তারিখ দেখা যায় আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এই অ্যাপয়েন্টমেন্টের কিউআর কোডটি স্ক্যান করলে দেখা যায়, সেখানে আবেদনকারীর নাম উঠছে আকমল হোসেন। তার বয়স ৪৪। আর আবেদনকারী আকমল উদ্দিন দুলুর বয়স ৪৩ বছর। আর হাসপাতালের নামের জায়গা দেখা যাচ্ছে তামিলনাড়ুর অন্য একটি ক্লিনিকের নাম।

 

 

 

অমূল্য কুমার নামের একজন ভিসার আবেদনকারী ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টের কাগজ ব্যবহার করেছেন। ওই কাগজের কিউআর কোডটি স্ক্যান করলে দেখা যায় যে, অ্যাপয়েন্টটি মুনমুন আক্তার নামের একজন নারীর। এটিও ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নয়। এটি তামিলনাড়ুর একটি ক্লিনিকের একজন সাধারণ চিকিৎকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। এই কাগজ দিয়ে অমূল্য কুমার ভিসার জন্য আবেদন করেছেন। তার চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাতের তারিখ দেখানো হয়েছে আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি।

 

 

 

ভুয়া কাগজ দিয়ে ভিসা নিয়ে ভারতে সত্যি সত্যিই চিকিৎসা নিতে গিয়েও বিপাকে পড়েছেন অনেক রোগী। ভারতের একটি হাসপাতাল থেকে এই ভুয়া অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার তথ্য বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, ওই রোগীর (অ্যাপয়েন্টমেন্ট) সাক্ষাৎপত্রটি ভুয়া। তাদের হাসপাতালের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তা বদল হয়ে গেছে। হাসপাতালের নামও বদল হয়ে গেছে। কিন্তু পুরাতন স্বাক্ষরকারী ও পুরাতন হাসপাতালের নামেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের ভিত্তিতে ভিসা ইস্যু করা হয়েছে। তারা বলেছেন, বাংলাদেশ থেকেই কেউ এরকম ভুয়া পত্র তৈরি করে রোগী পাঠাচ্ছেন।

 

 

 

সম্প্রতি এই হাসপাতালটি জানিয়েছে, ঠাকুরগাঁও ভিসা অফিসের পাশের মি. রায় নামের একজন ব্যক্তি ১ হাজার টাকার বিনিময়ে এই ধরনের ভুয়া অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার তৈরি করে বিক্রি করেছে। এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট এর ভিত্তিতে ভিসা নিয়ে সম্প্রতি ফজলুর রহমান তার স্ত্রী ফাতেমা বেগমকে নিয়ে ভারতে এসেছিলেন। তাদের কাছ থেকেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মি. রায়ের সম্পর্কে জানতে পেরেছে।

 

 

 

এসব প্রতারণার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে মঙ্গলবার ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র (আইভিএসি), বগুড়ার ইনচার্জ নাফিস আহমেদ ও নিরাপত্তা প্রহরী বেলাল আলীকে সাময়িকভাবে বহিস্কার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া জাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার তৈরির অভিযোগে শেখ মো. এনামুল হাসান তাসিন (২০) ও মো. রায়হান কবির (২১) নামে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে।

 

 

 

ঘটনা সূত্রে আরও জানা যায়, নওগাঁ জেলার আত্রাই থানার মোহনঘোষ এলাকার মো. হেলাল আলী নামের এক ব্যক্তি ভারতে যাওয়া জন্য গত ৫ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় রাজশাহীর বর্ণালী মোড়স্থ ভারতীয় ভিসা অফিসে ভিসা আবেদনের জন্য আসেন। এসময় একজনের কাছে তথ্য জানতে চাইলে তিনি রহমান লাইফ সোল্যুশনস নামক একটি দোকান দেখিয়ে দেন। তিনি সেখানে গেলে আসামিরা তাকে বলেন, ভিসা করতে হলে ভারতের হাসপাতালের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার-সহ বিভিন্ন কাগজপত্র লাগবে।

 

 

 

তখন হেলাল আলী উক্ত কাগজপত্র কোথায় পাবো বললে আসামিরা জানান, ৩ হাজার ৫০০ টাকা দিলে তারা সমস্ত কাগজপত্র তৈরি করে দিবে এবং তাদের দেওয়া কাগজপত্র ভারতের হাইকমিশনারের অফিসে জমা দিলেই ভিসা পাবেন। কথামতো হেলাল আলী টাকা প্রদান করেন। পরেরদিন তিনি জানতে পারেন, আসামিদের দেওয়া ভারতীয় ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার জাল হওয়ায় তার ভিসা পাওয়ার কোনো সম্ভবনা নাই।

 

 

 

তখন সে আসামিদের কাছে গিয়ে টাকা ফেরত চাইলে তারা বিভিন্ন তালবাহানা করে। এতে হেলাল আলী গত ১৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনারকে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আল মামুনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুদের নেতৃত্বে রহমান লাইফ সোল্যুশনস নামক দোকানে অভিযান পরিচালনা করে। এসময় মো. এনামুল হাসান তাসিন ও মো. রায়হান কবিরকে গ্রেপ্তার করেন। এসময় আসামিদের কাছ থেকে জাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার তৈরির কাজে ব্যবহৃত একটি কম্পিউটার, একটি কালার প্রিন্টার ও একটি স্ক্যানার উদ্ধার হয়।

 

 

 

গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মো. রফিকুল আলম বলেন, গ্রেফতার আসামিরা অজ্ঞাত ৪-৫ জনের সহায়তায় ভারতীয় ডাক্তারের জাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিতেন। অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে।

 

 

 

 

রাজশাহীস্থ ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার মনোজ কুমার বলেন, প্রতারণার সঙ্গে বাইরের দালালদের পাশাপাশি ভারতীয় ভিসা অফিসের কর্মকর্তাদেরও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফলে ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র (আইভিএসি), বগুড়ার ইনচার্জসহ দুইজনকে সাময়িকভাবে বহিস্কার করা হয়েছে। এছাড়া জাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার তৈরির অভিযোগে দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ভারতীয় ভিসা পাওয়া কঠিন নয় জানিয়ে তিনি দালালদের খপ্পরে না পড়ে সঠিক তথ্য দিয়ে আবেদন করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান।

সানশাইন / শামি


প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৩ | সময়: ৯:১৬ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine