সর্বশেষ সংবাদ :

মার্তিনেসের কাঁধে চড়ে সেমিতে আর্জেন্টিনা

স্পোর্টস ডেস্ক: তখন আর মিনিট খানেক বাকি, বা তার একটু বেশি। জয়ের সুবাস বইছে আর্জেন্টিনা শিবিরে। ঠিক ওই সময়ে দুর্দান্ত এক গোলে সব হিসাব এলোমেলো করে দিল নেদারল্যান্ডস। ম্যাচ গড়াল অতিরিক্ত সময় পেরিয়ে টাইব্রেকারে। যেখানে নায়ক হয়ে উঠলেন এমিলিয়ানো মার্তিনেস। প্রতিপক্ষের দুটি শট ঠেকিয়ে দলকে তুলে নিলেন কাতার বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে।
এক মার্তিনেসের মাথায় অবশ্য নায়কের মুকুট দেওয়ার উপায় নেই। শুরুটা যে ছিল মেসিময়। অসাধারণ এক অ্যাসিস্টে তিনিই গড়ে দেন এগিয়ে যাওয়ার পথ, পরে গোলও করেন। নির্ধারিত সময়ে জয়ের পথে ছিল তারা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে বদলি নামা ভঠ ভেহর্স্টের জোড়া গোলে ঘুরে দাঁড়ায় নেদারল্যান্ডস। তবে পেনাল্টি শুটআউটে মার্তিনেস গড়ে দিলেন চূড়ান্ত ব্যবধান। লুসাইল স্টেডিয়ামে শুক্রবার দ্বিতীয় কোয়ার্টার-ফাইনালে নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময় ২-২ গোলে শেষ হয়। পরে টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে জিতে উল্লাসে মাতে লিওনেল স্কালোনির দল।
পেনাল্টি শুটআউটে নেদারল্যান্ডসের প্রথম দুই শট নেওয়া ভার্জিল ফন ডাইক ও স্টিভেন বেরহাসকে রুখে দেন মার্তিনেস। অন্যদিকে, লিওনেল মেসির পর লেয়ান্দ্রো পারেদেসও লক্ষ্যভেদ করলে জয়ের পাল্লা হেলে পড়ে আর্জেন্টিনার দিকে। মাঝে এনসো ফের্নান্দেস লক্ষ্যভ্রষ্ট শট নিলেও তা তেমন ভাবনার কারণ হয়নি আর্জেন্টিনার জন্য, লাউতারো মার্তিনেসের নেওয়া শেষ শট জালে জড়াতেই উল্লাসে ফেটে পড়ে লুসাইল।
বিশ্বকাপের মঞ্চে ৩৬ বছরের অপেক্ষা ঘোচানোর পথে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা। সামনে এবার ক্রোয়েশিয়া বাধা, যারা এ দিনই রেকর্ড পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে হারিয়ে দিয়েছে। আন্ড্রিস নোপার্টের মস্তবড় ভুলে অষ্টম মিনিটে বিপদে পড়তে বসেছিল নেদারল্যান্ডস। বক্সে হুলিয়ান আলভারেস থাকা সত্ত্বেও তার পাশ দিয়ে ডান দিকে সতীর্থকে পাস দেন ডাচ গোলরক্ষক। বল নিয়ন্ত্রণে নিতে আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড চেষ্টা করেও পারেননি, বেঁচে যায় নেদারল্যান্ডস।
দুই দলের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা চললেও, উল্লেখযোগ্য কিছুই কেউ করতে পারছিল না। ২২তম ডান দিক দিয়ে আক্রমণে উঠে বক্সের বাইরে থেকে মেসি শট নেন, তবে লক্ষ্যের ধারে কাছেও তা ছিল না। ৩৩তম মিনিটে লক্ষ্যে প্রথম শট নেয় আর্জেন্টিনা। তবে বক্সের বাইরে থেকে রদ্রিগো দে পলের দুর্বল শট যায় গোলরক্ষক বরাবর। এর দুই মিনিট পরই উল্লাসে ভাসে আর্জেন্টিনা শিবির।
প্রতিপক্ষের জমাট রক্ষণে তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন মেসি। এক মুহূর্তের জাদুতে তিনিই গড়ে দেন গোলের পথ। ডান দিক দিয়ে ওঠা আক্রমণে একটু আড়াআড়ি বাঁ দিকে গিয়ে বাড়ান রক্ষণচেরা পাস। ডি-বক্সের মুখে প্রথম ছোঁয়ায় বল ভেতরে টেনে দ্বিতীয় টোকায় আগুয়ান গোলরক্ষককে ফাঁকি দেন মোলিনা। আন্তর্জাতিক ফুটবলে আতলেতিকো মাদ্রিদের এই ডিফেন্ডারের এটাই প্রথম গোল।
দ্বিতীয়ার্ধেও চাপ ধরে রেখে খেলতে থাকে আর্জেন্টিনা। যদিও নিশ্চিত কোনো সুযোগ মিলছিল না। ৬২তম মিনিটে বল পায়ে দারুণভাবে এগিয়ে যাওয়া মেসিকে আটকাতে বক্সের বাইরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন ফন ডাইক। বিপজ্জনক জায়গায় ফ্রি কিক পায় আর্জেন্টিনা। তবে মেসির শট রক্ষণ দেয়ালকে এড়লেও ক্রসবারের ওপর দিয়ে যায়। ৭৩তম মিনিটে মেসির সফল স্পট কিকে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেয় আর্জেন্টিনা। বাঁ দিক দিয়ে বক্সে ঢোকার মুখে মার্কোস আকুনিয়াকে ডিফেন্ডার ডেনজেল ডামফ্রিস ফাউল করলে পেনাল্টিটি পায় আর্জেন্টিনা। মেসির শটে জায়গা থেকে নড়ার সুযোগ পাননি গোলরক্ষক।
বিশ্বকাপে মেসির গোল হলো ১০টি; স্পর্শ করলেন আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা গাব্রিয়েল বাতিস্তুতার রেকর্ড। ৮৩তম মিনিটে ব্যবধান কমিয়ে লড়াই জমিয়ে তোলেন ভেহর্স্ট। স্টিভেন বেরহাসের বাঁ দিকের সাইডলাইন থেকে বাড়ানো ক্রসে দুর্দান্ত হেডে দলের নিভতে বসা আশা জাগিয়ে তোলেন বেসিকতাসের ফরোয়ার্ড।
দুই মিনিট পর তারা আবারও প্রতিপক্ষ শিবিরে ভীতি ছড়ায়। এবার বেরহাসের জোরাল শট নিকোলাস তাগলিয়াফিকোর পায়ে লেগে পাশের জালে কাঁপায়। আর্জেন্টিনা শিবিরে জোরাল হয় জয়ের আশা। একটু একটু করে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে ম্যাচ গড়ায় যোগ করা সময়ে। গোলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে ডাচরা। তবে আর্জেন্টিনা রুখে দিতে থাকে সব। ১০ মিনিট যোগ করা সময়ের শেষ মিনিটে খেলা চলছে। লুসাইলের গ্যালারিতে তখন নীল-সবুজের উত্তাল ঢেউ। অপেক্ষা শেষের বাঁশির।
এমন সময়ে বক্সের বাইরে বিপজ্জনক জায়গায় ভেহর্স্টকে ফাউল করে বসলেন হেরমান পেস্সেইয়া। রেফারির সঙ্গে তর্ক করে হলুদ কার্ড দেখলেন মেসি। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে বদলি নামা টিউন কুপমেইনার্স নিলেন দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত ফ্রি-কিক, রক্ষণ দেয়ালের ওপর দিয়ে নয়, পাশ দিয়ে বাড়ালেন বক্সে। প্রস্তুত ছিলেন ভেহর্স্ট, বল ধরে সঙ্গে লেগে থাকা প্রতিপক্ষকে কোনোরকম সুযোগ না দিয়ে বাঁ পায়ের শটে বল পাঠালেন জালে।
নীল-সাদার উত্তাল ঢেউ থেমে গেল, শুরু হলো কমলা রংয়ের উন্মাদনা। অতিরিক্ত সময়ের ১৪তম মিনিটে মেসির ফ্রি-কিকে একটা হাফ চান্স পেয়েছিলেন ওতামেন্দি, কিন্তু বলে পা ছোঁয়াতে পারেননি তিনি। ম্যাচের ১১০তম মিনিটে বল উড়িয়ে মারেন মেসি। তিন মিনিট পর বক্সে দুই দফায় ফাঁকায় বল পেয়ে যান লুক ডি ইয়ং। তবে সামনে প্রতিপক্ষের অনেক খেলোয়াড়ের ভিড় ভেদ করতে পারেননি তিনি। পরের মিনিটে সুযোগ নষ্ট হয় আর্জেন্টিনার, বক্সের মধ্যে থেকে লাউতারো মার্তিনেসের শট ভার্জিল ফন ডাইকের গায়ে লাগে।
শেষের কয়েক মিনিটে প্রবল চাপ বাড়ায় আর্জেন্টিনা। দারুণ কয়েকটি সুযোগও মেলে; কিন্তু হতাশার বৃত্ত আর ভাঙতে পারেনি তারা। মার্তিনেসের বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া শট ঠেকিয়ে দেন গোলরক্ষক। আর একেবারে শেষ মিনিটে ফের্নান্দেসের দূরপাল্লার শট গোলরক্ষককে ফাঁকি লাগে পোস্টে। সমতা ভাঙতে শুরু হয় টাইব্রেকার। যেখানে ফন ডাইকের ব্যর্থতা আর মার্তিনেসের নৈপুণ্য দিয়ে শুরু। সফল শটে শেষ করেন আরেক মার্তিনেস, স্ট্রাইকার লাউতারো মার্তিনেস। মেসিদের মুখে তখন চওড়া হাসি, সেমি-ফাইনালে ওঠার আনন্দ। আর গ্যালারিতে নীল-সবুজ ঢেউ যেন আরও উত্তাল। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে একই মাঠে আগামী মঙ্গলবার ক্রোয়েশিয়ার মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনা।


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২২ | সময়: ৬:১১ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ