সর্বশেষ সংবাদ :

১৫ বছরের খরা কাটানো জয়ে স্বস্তির শুরু বাংলাদেশের

স্পোর্টস ডেস্ক: হোবার্টের প্রকৃতির মন ভার সকাল থেকেই। বৃষ্টি না হলেও কালো মেঘে ঢাকা আকাশ। তেমনি বেলেরিভ ওভালের আবহও তখন গুমোট। স্কোরবোর্ডে মাঝারি পুঁজি, গ্যালারিতে হাজারখানেক বাংলাদেশি সমর্থকের মনে অনিশ্চয়তার ছাপ। দুটি বলেই সব বদলে দিলেন তাসকিন আহমেদ। জোড়া উইকেট নিয়ে উড়তে থাকলেন তিনি। বদলে গেল দলের শরীরী ভাষা। গ্যালারি থকে ভেসে এলো গর্জন। সেই প্রবাহে ভেসেই শেষ পর্যন্ত ধরা দিল জয়।
বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের অস্বস্তি মিলিয়ে গেল বোলিং-ফিল্ডিংয়ে। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৯ রানের জয়ে সাকিব আল হাসানরা শুরু করলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অভিযান। জয়ের ব্যবধান খুব একটা বড় না হলেও রান তাড়ায় ম্যাচে তেমন কোনো সম্ভাবনা জাগাতে পারেনি নেদারল্যান্ডস। বাজে শুরুর পর কলিন আকারম্যানের লড়াই আর শেষ দিকে কিছু বড় শটে তারা কমাতে পারে ব্যবধান।
ডাচদের বিপক্ষে এমন জয় হয়তো প্রত্যাশিতই। তবে এই জয়টি বহুকাঙ্ক্ষিত। সাম্প্রতিক বাস্তবতায় যেমন জরুরি ছিল এই সাফল্য, দীর্ঘ খরার পর খানিকটা স্বস্তির জলধারায় দেশের ক্রিকেটকে ভিজিয়ে দেওয়া জয়ও এটি। সেই ২০০৭ সালে প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর পর অবশেষে মূল পর্বে আরেকটি জয়ের স্বাদ পেল বাংলাদেশ।
ব্যাটিংয়ে খুব ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। ডাচদের বোলিং ধারাল না হলেও ২০ ওভারে রান আসে ১৪৪। বোলিংয়ের শুরুটায় পুষিয়ে গেছে তা। নেদারল্যান্ডস শুরুতে ধুঁকলেও শেষ পর্যন্ত করতে পারে ১৩৫ রান। ইনিংসের প্রথম দুই বলেই উইকেটের সঙ্গে পরে আরও দুটি যোগ করে ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ে টি-টোয়েন্টিতে প্রথমবার ম্যাচ সেরার স্বীকৃতি পান তাসকিন।
হোবার্ট শহরে এমনিতেই ক্রিকেটের উন্মাদনা খুব একটা নেই। প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যাও খুব বেশি নয়। তারপর আবার উইকেন্ড না হওয়ায় অনেকে আসতে পারেননি কাজ ফেলে। সব মিলিয়ে তাই গ্যালারিতে দর্শক উপস্থিতি স্রেফ হাজারের মতো। তাদেরকে মাতিয়ে ৫ ওভারে ৪৩ রান তুলে ফেলেন নাজমুল হোসেন শান্ত ও সৌম্য সরকার।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এমন শুরু আসলে নিয়মিতই দেখা যায় প্রায় সব দলে। কিন্তু বাংলাদেশ দলে এটিই বিরল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ৩০ ম্যাচ পর উদ্বোধনী জুটিতে রান ছাড়াল ৪০! ম্যাচের প্রথম ওভারে সৌম্যর দুই বাউন্ডারিতে রান আসে ১২। পরে শান্তর ফ্লিক, দৃষ্টিনন্দন অন ড্রাইভ, লফটেড স্ট্রেট ড্রাইভে বাড়তে থাকে রান।
তবে সেই শুরুটাকে কাজে লাগাতে পারেননি দুই ওপেনারের কেউ, পারেননি পরের দুই ব্যাটসম্যানও। স্কিড করা বলে দুর্বল পুলে বিদায় নেন সৌম্য (১৪ বলে ১৪), পরের ওভারে স্লগ সুইপে ফেরেন শান্ত (২০ বলে ২৫)। লিটন কুমার দাসের ব্যতিক্রমী এক দিন ছিল এটি। উইকেটে অস্বস্তিময় উপস্থিতি শেষে তিনি ফেরেন আলগা শটে (১১ বলে ৯)। ছক্কার চেষ্টায় সীমানায় বাস ডে লেডের দারুণ ক্যাচে ফেরেন সাকিব (৯ বলে ৭)। বাংলাদেশ অধিনায়ককে ফিরিয়ে বিশ্বকাপ অভিষেক স্মরণীয় করে রাখেন নেদারল্যান্ডসের টিনএজ লেগ স্পিনার শারিজ আহমাদ।
৪ ওভারে ২০ রানের মধ্যে ৪ উইকেট হারিয়ে তখন কম্পমান বাংলাদেশ। একটু পর দলকে আরও বিপদে ফেলে ফুল লেংথ বলে দৃষ্টিকটু শটে ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে বোল্ড হন ইয়াসির আলি। আফিফ হোসেনের ‘নরম্যাল সার্ভিস’ শুরু হয় সেখান থেকেই। বরাবরই বিপর্যয়ে ত্রাতা এই তরুণের ব্যাট আরও একবার ভরসা জোগায় দলের প্রয়োজনে। তার সঙ্গে জুটিতে এক প্রান্ত আগলে রাখেন নুরুল হাসান সোহান।
রানের গতি কমে যায় এ সময়। টানা ২৮ বলে আসেনি কোনো বাউন্ডারি। অবশেষে আফিফের চার ও ছক্কায় দল পেরিয়ে যায় শতরান। সোহান জুটিতে সঙ্গ দিলেও সময়ের দাবি মেটাতে পারেননি (১৮ বলে ১৩)। দুটি করে চার ও ছক্কার ইনিংসে ২৮ রানে জীবন পেয়ে আফিফ থমকে যান ৩৮ রানে (২৭ বলে)।
শেষ দিকে দ্রুত কিছু রান আসে মোসাদ্দেক হোসেনের সৌজন্যে। তার ১২ বলে ২০ রানের ইনিংসেই ১৪০ ছাড়াতে পারে দল। ইনিংস বিরতিতে দারুণ এক জয়ের আশা নিশ্চয়ই জেগেছিল ডাচদের ড্রেসিং রুমে। তবে প্রথম দুই বলেই তাদের আশায় বড় ধাক্কা দেন তাসকিন। গতিময় দুটি ডেলিভারিতে ফিরিয়ে দেন বিক্রমজিত সিং ও বাস ডে লেডেকে। প্রথমটিতে স্লিপে দুর্দান্ত ক্যাচ নেন ইয়াসির, পরের ক্যাচ নেন সোহান।
এই দুটির রেশ কাটতে না কাটতেই আরও দুটি উইকেট বাংলাদেশ পেয়ে যায় বোনাস। সাকিবকে ছক্কার পরের বলেই নিজের ভুলে রান আউট হন ওপেনার মাক্স ও’ডাউড। এক বল পর আরেক বড় ভরসা টম কুপারও রান আউট হয়ে যান কোনো বল না খেলে। ১৫ রানে নেই ৪ উইকেট। নেদারল্যান্ডসের সম্ভাবনারও প্রায় মৃত্যু।
লড়াই অবশ্য ছাড়েনি তারা। কাউন্টি ক্রিকেটের পরিচিত মুখ আকারম্যান তার অভিজ্ঞতার সবটুকু মেলে ধরেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দেড়শর বেশি ম্যাচ খেলে ২০টি সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যান একটু একটু করে দলকে এগিয়ে নেন। ১৬ রানে ইয়াসিরের কাছে জীবন পেয়ে তা কাজে লাগান ভালোভাবেই। যদিও কখনও মনে হয়নি, ম্যাচ জেতার মতো অবস্থানে আছে নেদারল্যান্ডস।
তাসকিন দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে এক ওভারে উইকেট নেন আরও দুটি। ৪৮ বলে ৬২ রান করা আকারম্যানকে ফিরিয়ে তিনি পূর্ণ করেন চার উইকেট। ৪১ ম্যাচের ক্যারিয়ারে আগে কখনোই ইনিংসে দুই উইকেটের বেশি নেননি। এবার ৫ উইকেটের সম্ভাবনাও জাগান। নিজের শেষ বলে দুর্দান্ত এক ইয়র্কার করেন। পল ফন মেকেরেনের ব্যাটের কানায় লেগে তা চলে যায় বাউন্ডারিতে।
১০৫ রানে নেদারল্যান্ডস হারায় ৯ উইকেট। বাংলাদেশ তখন বড় জয়ের পথে। কিন্তু ডাচদের শেষ ব্যাটসম্যান ফন মেকেরেন দ্রুত কিছু রান তুলে ব্যবধানটাকে কাছাকাছি নিয়ে যান। ইনিংসের শেষ বলে তার বিদায়েই শেষ হয় ম্যাচ। বাংলাদেশের বোলিংয়ের শেষটা নিখুঁত হয়নি। মুস্তাফিজুর রহমান রান খুব বেশি না দিলেও পাননি উইকেটের দেখা। তবে জয়টা এসেছে, শুরুতে পা হড়কায়নি, এটাই আপাতত দলের জন্য স্বস্তির।


প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২২ | সময়: ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ