সর্বশেষ সংবাদ :

প্রাণহানী এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা বজ্রপাতের সময় এখন

স্টাফ রিপোর্টার: জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের আবহাওয়ার একটি নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। কাল-বৈশাখ মৌসুমে দেশের আকাশে বজ্রমেঘের উপস্থিতি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আর সে কারণে দেশে বজ্রপাতের পরিমাণও বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। শেষ পর্যন্ত বজ্রপাত এ দেশে এতোই আতঙ্কে রূপ নিয়েছে যে ২০১৬ সালে ‘বজ্রপাত’ একটি দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত হয়। বর্তমান সময়ে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়েছে। মানুষকে এ মৃত্যু থেকে রক্ষা করতে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণার কোন বিকল্প নেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসকারি সংগঠন ‘ডিজাস্টার ফোরাম-এর তথ্যমতে, এদেশে প্রতি বছর গড়ে বজ্রপাতে ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়।
এর মধ্যে ৭০ শতাংশই মাঠে থাকা কৃষক। যারা খোলা মাঠে কাজ করে। সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ি ফেরার পথে, আর ১৩ শতাংশ গোসল কিংবা মাছ শিকারের সময়। তবে শহরের ভবনগুলোতে বজ্রপাত প্রতিরোধক দণ্ড থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম। ২০১১-এর শুরু থেকে ২০২২ পর্যন্ত ১২ বছরে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ১৬২ জনের। সাধারণত এপ্রিল ও জুনে বজ্রপাত বেশি হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি সংগঠন ‘ডিজাস্টার ফোরাম’-এর তথ্য মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে বজ্রাপাতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ১৬২ জনের। এর মধ্যে ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন, ২০২০ সালে ২৩৬ জন। ২০২১ সালে ৩৬২ জন মারা গেছে বজ্রাপাতে। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছেন ২৭৪ জন। আর ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বজ্রপাতে ৬৬ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
চলতি বছরে বিগত বছরগুলোর তুলনায় আরো বেশি বজ্রঝড়ের আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। তারা জানান, সবচেয়ে বেশি বজ্রঝড় হয়ে থাকে মে মাসে। যেখানে গড়ে ৮টি বজ্রঝড় হওয়ার কথা সেখানে এবারের মে মাসে গড়ে ১৩টি ঝড় হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশে ১১মে পর্যন্ত কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক রাজিব খান জানান, যেসব মেঘ বজ্রপাত ঘটায় তাকে বজ্রমেঘ বলা হয়। এসব মেঘ বাতাসে ভর করে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় প্রবাহিত হয়। আমাদের দেশে যেসব বজ্রমেঘ প্রবাহিত হয় তা দেশের বাইরে থেকে প্রবেশ করে থাকে। মেঘগুলো দেশের এক প্রাপ্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় নিয়ে থাকে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবেই বেশি বজ্রপাত হয়। এসব অঞ্চলে বজ্র মেঘের সৃষ্টিই হয় বেশি।
বজ্রপাতের অন্যতম কারণ হচ্ছে তাপপ্রবাহ ও পশ্চিমা লঘুচাপের মিশ্রণ। অর্থাৎ দক্ষিণের গরম বাতাস আর পশ্চিমা লঘুচাপের মিশ্রণের কারণে প্রচুর বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়। মেঘের মধ্যে থাকা ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের গঠন ও পরিবহনের ফলে বজ্রপাত হয়। চলতি বছর দেশে অন্যবারের তুলনায় তাপপ্রবাহ বেশি ছিল। তাই বজ্রপাতের আশঙ্কা এবার বিগত সময়গুলোর চেয়ে বেশি হতে পারে।
বজ্রপাত তিন ধরনের। এক ধরনের বজ্রপাত এক মেঘ থেকে আরেক মেঘে হয়। অন্য ধরনের বজ্রপাত এক মেঘের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে হয়। আর অন্যটি হয় মেঘ থেকে ভূমিতে আর এটি ভয়ঙ্কর।
বজ্রপাত থেকে প্রাণ রক্ষা করতে ব্যাপকভাবে প্রচারণা প্রয়োজন। কারণ অসচেতনতার কারণেই বজ্রপাতে মানুষ প্রাণ হারায় বেশি। বিভিন্ন গণমাধ্যম বজ্রঝড় নিয়ে নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে এ প্রচারণা মাঠ পর্যায়ে হওয়া প্রয়োজন।
আবহাওয়াবিদরা জানান, বজ্রপাত ও বজ্রঝড়ের সময় কিছু নিয়ম মেনে চলা প্রয়োজন। যেমন বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ না করা, প্রতিটি ভবনে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন, খোলাস্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যাওয়া।
এছাড়া বাড়িতে আলাদা আলাদা কক্ষে অবস্থান নেওয়া, খোলা জায়গায় কোনো বড় গাছের নিচে আশ্রয় না নিয়ে কমপক্ষে চার মিটার দূরে থাকা, ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার, তার ও খুঁটি থেকে থাকা, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি আনপ্লাগ করা, আহতদের বৈদ্যুতিক শকে মতো চিকিৎসা দেওয়া। আকাশে মেঘ দেখা গেলে ঘরে অবস্থান করা, দ্রুত দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া, জানালার কাছাকাছি বা বারান্দায় না থাকা এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকা, ঘন-কালো মেঘ দেখা গেলে রাবারের জুতা পরে বাইরে বের হওয়া, উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, তার, ধাতব খুঁটি ও মোবাইল টাওয়ার থেকে দূরে থাকা, বজ্রপাতের সময় জরুরি প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা।
এছাড়াও খোলা জায়গা, মাঠ বা উঁচু স্থানে না থাকা, কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা, জলাশয় থেকে দূরে থাকা, বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে থাকলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়া, বজ্রপাতের সময় গাড়ির মধ্যে অবস্থান করলে, গাড়ির থাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ না ঘটানো এবং সম্ভব হলে গাড়িটিকে নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয়া এবং বজ্রপাতের সময় মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করা যাবে না।
সিনিয়র পর্যবেক্ষক রাজিব খান জানান, সাধারণত লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, আমাদের দেশের কাল-বৈশাখী ঝড়গুলো বিকেল থেকে শুরু করে ভোর পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর একটি কারণ হচ্ছে বজ্রমেঘগুলো দেশের বাহিরে থেকে সাধারণত বিকেলে প্রবেশ করে। বাতাসে ভেসে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে সকালের মধ্যেই দেশের সীমানা অতিক্রম করে। তাই সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত সময়ে বজ্রপাতের শঙ্কা বেশি থাকে।
এই বজ্রমেঘগুলো এক জায়গায় বেশিক্ষণ স্থির থাকে না। মেঘগুলো ৩০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা পর্যন্ত স্থির থাকে। আকাশে বজ্রমেঘ দেখা দিলে ওই সময়টুকু নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নিলে নিজেকে নিরাপদ রাখা যায়।


প্রকাশিত: মে ৯, ২০২৪ | সময়: ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ