বড় মাঠের বড় চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ

স্পোর্টস ডেস্ক: ব্রিজবেনের অ্যালান বোর্ডার মাঠে শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচ হয় নিয়মিতই। ঘরোয়া অন্যান্য প্রতিযোগিতার খেলা হয়, মেয়েদের বিগ ব্যাশ তো বটেই, আন্তর্জাতিক ম্যাচও হয়ে আসছে এখানে প্রায় দুই যুগ ধরে। দারুণ সব সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ এক ক্রিকেট কমপ্লেক্স এটি। ছেলেদের আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনও খুবই সম্ভব। তবে অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য পরিচিত ভেন্যুগুলোর তুলনায় একটি জায়গায় এই মাঠ পিছিয়ে। ‘প্লেয়িং এরিনা’ এখানে তুলনামূলক ছোট।
অস্ট্রেলিয়ায় পা রাখার পর থেকে বাংলাদেশ দল এখানেই অনুশীলন করছে। নেট অনুশীলন থেকে শুরু করে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এখানে দারুণ। বাংলাদেশ তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে পুরোপুরি। প্রস্তুতি ম্যাচ শেষেও এখানে বাড়তি দুই দিন থেকে যেতে হওয়ায় দল থেকে আপত্তি খুব একটা নেই এখানকার সুযোগ-সুবিধার কারণেই। তবে প্রস্তুতির একটা বড় অংশ ফিল্ডিং ও রানিং বিটুইন দা উইকেট অনুশীলন এখানে পর্যাপ্ত ও আদর্শ হচ্ছে না বলেই মনে হয়।
২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের বড় দুর্ভাবনার জায়গা ছিল অস্ট্রেলিয়ায় মাঠের বড় আকৃতি। বড় মাঠ মানেই বেশি ফাঁকা জায়গা আর এক-দুই-তিন রানের সুযোগ অনেক বেশি। রানিং বিটুউইন দা উইকেট তাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত দৌড়ানো এবং ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। ফিটনেসের ব্যাপারটিও চলে আসে এখানে। বাংলাদেশের যে জায়গায় ঘাটতি ছিল ৭ বছর আগে, আছে এখনও।
বড় মাঠের আরেকটি বড় পরীক্ষা ফিল্ডিংয়ে। ফাঁকা জায়গা বেশি বলেই প্রতিটি ফিল্ডারকে অনেক বেশি জায়গা পাহারা দিতে হয়। বলের কাছে দ্রুত ছুটে যাওয়া, ম্যাচ জুড়ে ছুটে বেড়ানোর মতো ফিটনেস ও শরীরের সেই সহনশীলতা এখানে জরুরি। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, হাতের জোর। সীমানা থেকে থ্রো করে সরাসরি স্টাস্পে বল পাঠানো এবং দ্রুত পুরো প্রক্রিয়া শেষ করা এখানে বড় চ্যালেঞ্জ। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের বড় দুর্বলতা এখানে আগেও ছিল। এখনও আছে।
যদিও টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ দলের অবস্থা হলো, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা।’ অনেক বড় সমস্যা, ঘাটতি, দুর্বলতার জায়গা এই দলে আছে। মৌলিক জায়গাগুলোতেই এত পিছিয়ে দল, উন্নতির সুযোগ এত বেশি, উন্নতির অগ্রাধিকার তালিকায় এসবই থাকবে ওপরে। বড় মাঠের ছোট ছোট ব্যাপারগুলিতে উন্নতির ব্যাপার এখানে থাকরে নিচের দিকে।
পাওয়ার হিটিংয়ের ব্যাপারটিই যেমন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে যেটি তুমুল আলোচিত। পেশির জোর কিংবা বড় শটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের চিরন্তন দুর্বলতা আরও বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হবে অস্ট্রেলিয়ার মাঠগুলোতে। তবে এই মাঠগুলোর বিশেষ দিক হলো, মাঠের সব প্রান্তেই সীমানা কিন্তু বিশাল নয়! বরং একই মাঠের নানা প্রান্তের সীমানায় ফারাক আছে অনেক।
বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচের ভেন্যু হোবার্টের বেলেরিভ ওভালে যেমন মাঝখানের উইকেট থেকে সোজাসুজি সীমানা এক প্রান্তে ৮০ মিটার। সেই অংশের ঠিক পাশে, ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্য যেটি হবে ওয়াইড লং অন, সেখানে সীমানা ৮২ মিটার। ঠিক উল্টোদিকে যদি সীমানা ধরা হয়, সোজাসুজি একদিকে সীমানা ৭০ মিটার, আরেক দিকে ৫৯ মিটার। মাঝখানের উইকেট থেকে এক প্রান্তের সীমানা ৫৬ মিটারও আছে।
দ্বিতীয় ম্যাচের ভেন্যু সিডনি ক্রিকেট মাঠে দুই প্রান্তে সোজাসুজি সীমানা ৮০ মিটার ও ৭৬ মিটার পর্যন্ত। মাঝখানের উইকেট থেকে স্কয়ার সীমানা আবার নেমে আসে ৬৮ ও ৬৬ মিটার পর্যন্ত। ব্রিজবেনের গ্যাবায় সোজাসুজি সীমানা ৭১ মিটার, পাশেই ৭৫ মিটার। এই মাঠেই আবার উল্টোদিকের সোজাসুজি সীমানা ৬৩ মিটার।
অ্যাডিলেইড ওভালে একইভাবে সোজাসুজি সীমানা দুই প্রান্ত ৭৯ ও ৮০ মিটার, তেমনি মাঝখানের উইকেট থেকে স্কয়ার বাউন্ডারি ৬২-৬৩ মিটার। মাঠের আকৃতি বুঝে তাই ‘স্মার্ট’ ব্যাটিং করা এখানে হবে গুরুত্বপূর্ণ। বড় শটের জন্য সঠিক বোলার ও অ্যাঙ্গেল বেছে নেওয়া, উপযুক্ত সময় উপলব্ধি করতে পারা, পরিস্থিতি বুঝে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা গড়ে দেবে বড় পার্থক্য। তেমনি ফাঁকা জায়গায় বল ঠেলে দুই-তিন রান নেওয়া, বড় সীমানার দিকে আলতো হাতে শট খেলে দ্রুত দুই-তিন রান নেওয়া হবে জরুরি।
তেমনি কোন সময়টায় কোন জায়গা দিয়ে বাতাসের প্রতিকূলে বড় শট খেলায় ঝুঁকি কম, কোন সময়টায় ঝুঁকি বেশি, কখন বাতাসের অনুকূলে কোন বোলারদের খেলা যায়, এই পরিস্থিতিগুলো পড়তে পারাও গুরুত্বপূর্ণ। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের যে ইতিহাস ও এখনকার বাস্তবতা, তাতে ওয়ানডে ক্রিকেটেও এখানে বাংলাদেশের বেশ দুর্বলতা স্পষ্ট। টি-টোয়েন্টিতে তা আরও বেশি দৃশ্যমান। স্মার্ট ক্রিকেট খেলা, স্কিল হিটিংয়ের মতো ব্যাপারগুলি নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে আলোচনা হয়ে আসছে অনেক। কিন্তু এখানে উন্নতি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের ছাপ ব্যাটসম্যানরা খুব একটা রাখতে পারেনি।
তবে প্রচলিত এই সব ধারণার চেয়ে পুরো উল্টো মত শ্রীধরন শ্রীরামের। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা তার। এখানকার ভেন্যুগুলোর সব দিক তার জানা। বাংলাদেশ দলকেও তিনি এখন ভালোভাবে জানেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। ব্রিজবেনে বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে দলের টেকনিক্যাল কনসালটেন্টের তাবি, তার দলের সুবিধাই হবে এসব বড় মাঠে।
“(বড় সীমানা) আমাদের সহায়তাই করবে। কারণ আমাদের ব্যাটসম্যানরা পছন্দ করে বলের গতি কাজে লাগাতে। আমরা পাওয়ার হিটার নই, বলের গতির ওপর নির্ভর করি। বড় সীমানা তাই ব্যাটসম্যানদের সহায়তা করবে, যদি তারা সঠিক পকেটে বল ঠেলতে পারে এবং রানিং বিটুউন দা উইকেট ভালো হয়।”
“এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি, ফিল্ডিং পজিশন অনুযায়ী জায়গামতো বল ঠেলে দ্রুত দৌড়ানো এবং সুযোগমতো বাউন্ডারি আদায় করা। সঠিক গতিটা ধরতে পারলে আমরা ভালো করব।” শ্রীরামের ভাবনা তাত্ত্বিকভাবে হয়তো সঠিকই। তবে যে শর্তগুলি তিনি জুড়ে দিয়েছেন, ‘সঠিক পকেটে বল ঠেলে দেওয়া’, ‘দ্রুত দৌড়ানো’, বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা তো সেখানেই!


প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২২ | সময়: ৬:২২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ