সাক্ষীরা লাপত্তা: আলফ্রেড হত্যার বিচারে অনিশ্চয়তা

নওগাঁ প্রতিনিধি: আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন (৩৬) এর ২২তম মৃত্যু বার্ষিকী। ২২ বছর আগে অলফ্রেড সন্ত্রাসীদের দ্বারা নির্মম ভাবে নিহত হলেও এখনো ওই মামলার কোন সুরাহা হয়নি। আন্তর্জাতিক ভাবে আলোচিত ওই মামলার ভবিষ্যত নিয়ে আদিবাসীদের রয়েছে সংশয়। তাদের অভিযোগ জামিনে থাকা আসামীরা তাদের অব্যাহত ভাবে হুমকী-ধমকী দেয়ায় ইতোমধ্যে অনেক আদিবাসী পরিবার ভীমপুর আদিবাসী পলল্লী ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।
বর্তমানে যে ৭টি পরিবার এখনো বসবাস করছে তারা ভূমিদস্যুদের ভয়ে জমিতে চাষাবাদ করতেও পারছে না। ফলে চরম অভাব অনটন ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যদিয়ে দিন অতিবাহিত করছে। পল্লী ছেড়ে মামলার সাক্ষীরা চলে যওয়ায় মামলার ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার বাদী আলফ্রেডের ছোট বোন রেবেকা সরেন।
ভীমপুর আদিবাসী পল্লীর বর্তমান অবস্থা সরজমিন নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, নিঝুম নিস্তব্ধ পল্লীটিতে প্রাণচাঞ্চল্য আজ আর নেই। ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে বসবাস করছে এখনো কয়েকটি পরিবার। রেবেকা সরেন শত হুমকীর মধ্যে সেখানে রয়েছেন শুধু তার প্রাণ প্রিয় ভাইয়ের হত্যার বিচার দেখে যাওয়ার অপেক্ষায়।
পল্লীর এক ধারে বাঁশ ঝাড়ের ছায়ায় অযত্নে পড়ে রয়েছে আদিবসী নেতা আলফ্রেড সরেনের সমাধী। আদিবাসীদের চোখে মুখে অতংকের ছাপ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলার জামিনে থাকা আসামীদের অব্যাহত হুমকী ধমকীতে ২৪টি পরিবারের মধ্যে বর্তমানে নতুন ও পুরাতন মিলে সেখানে বসবাস করছে মাত্র ৭টি পরিবার। বাঁকীরা জীবনের ভয়ে অন্যত্র চলে গেছে। নিহত আলফ্রেড সরেনের বৃদ্ধ বাবা গায়না সরেন আজ আর বেঁচে নেই।
২০০৮ সালে তিনি মারা যান। তিনিও অব্যহত হুমকী ধমকীতে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। আলফ্রেড সরেন হত্যা কান্ডের এক বছরের মাথায় তার মা ঠাকুরানী সরেন ছেলের শোকে মৃত্যু বরন করেন। আলফ্রেড সরেনের স্ত্রী জোছনা সরেন দিনাজপুর জেলার একটি এনজিওতে চাকরী করছেন। মেয়ে ঝর্ণা সরেন এখন গার্মেন্টস কর্মী। তার বিয়ে হয়েছে।
সেদিন যা ঘটেছিল: আলফ্রেডের ছোট বোন রেবেকা সরেন সেদিনের ভয়াবহ ঘটনার বর্ননা দিতে গিয়ে বলেন, ১৮ আগস্ট ২০০০ সালে ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে ভূমিদস্যু হাতেম- গদাই গংদের সন্ত্রাসীদের হামলায় তার ভাই আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন নৃসংশভাবে খুন হন।
ওই ঘটনায় সন্ত্রাসীরা ব্যাপক তান্ডব চালিয়ে আদিবাসী পল্লীর ১১টি পরিবারের বাড়িঘর ভাংচুর লুটপাটসহ অগ্নিসংযোগ করে। ওই সময় তাদের হামলায় আদিবাসী মহিলা-শিশুসহ প্রায় ৩০ জন মারাত্মক আহত হয়। ঘটনার সময় আদীবাসীদের কয়েকজন শিশুকে সন্ত্রাসীরা পল্লী¬র পার্শ্ববর্তী পুকুরে নিক্ষেপও করেছিল।
সন্ত্রসীরা যখন আদিবাসী পল্লী¬তে হামলা চালায় তখন বেলা ১২টা। ঘটনার দিনটি ছিল শুক্রবার। ওইদিন নওগাঁ-মহাদেবপুর সড়কের চৌমাসিয়ার মোড়ে জুম্মার নামাজের পর ভীমপুরের আদিবসীদের উপর ভূমিদস্যুদের অত্যাচারের প্রতিবাদে সমাবেশের আয়োজন করেছিল আদিবাসীরা। আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন সবকিছুর আয়োজন করে বেলা ১২টার দিকে বাড়িতে যান পান্তা খেতে। পল্ল¬ীর অধিকাংশ পুরুষ ওই সময় চৌমাসিয়ার মোড়ে সমাবেশ স্থলেই ছিল। গ্রাম ছিল পুরুষ শূন্য।
আলফ্রেড বাড়িতে যেতেই সন্ত্রাসী বাহিনী সেই সুযোগটি নিয়েছিল। আলফ্রেড বুঝতে পেড়ে নিজের ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে আশ্রয় নেন। আলফ্রেড যে ঘরটিতে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন সেই ঘরটিতে তারা আগুন ধরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে আলফ্রেডকে বের হতে বাধ্য করে। আলফ্রেড বেরিয়ে আসা মাত্র ঘাতকরা তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। তাকে যেকোন সময় হত্যা করা হতে পারে এমনটি আঁচ করতে পেরেছিলেন আলফ্রেড সরেন। সেদিন ওই সন্ত্রাসী ঘটনার সময় রেবেকা সরেন তার ভাতিজী আলফ্রেড সরেনের মেয়ে ঝর্ণাকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে ছিল।
তবে সন্ত্রাসীদের আঘাতে আলফ্রেডের স্ত্রী জোছনা সরেনের একটি চোখ মারাত্মক ভাবে জখম হয়েছিল। পরবর্তিতে নিরাপত্তার জন্য সেখানে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছিল। পরে তা গুটিয়ে নেয়া হয়।
হত্যাকান্ডের আগের দিনের চিঠি: ৯ আগস্ট ২০০০ সালে নওগাঁর মুক্তির মোড় কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার পাদদেশে আন্তর্জাতিক আদিবসী দিবসে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তাকে হত্যা করা হতে পারে এমন আশংকার বিষয় আলফ্রেড সরেন নওগাঁর সিপিবির নেতা ময়নুল হক মুকুল, মহসীন রেজাসহ আরো কয়েকজনকে বলেছিলেন সমাবেশের দিন। সবাই তাকে সতর্কভাবে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে বর্তমান নওগাঁ জেলা সিপিবি’র সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ময়নুল হক মকুল জানান।
মহসীন রেজা জানান, হত্যাকান্ডের ঠিক আগের দিন ১৭ আগস্ট আলফ্রেড মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান আমজাদ হোসেন তারাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে ছিল তাকে যারা হত্যা করতে পারে এমন সন্দেহভাজন ১০ জনের নাম।
সভাস্থলে যে খবর আসে: আদিবাসীদের ডাকা চৌমাসিয়ার মোড়ে সেই সভায় সেদিন বক্তব্য দেয়ার জন্য উপস্থিত ছিলেন নওগাঁর সাবেক সিপিবি’র সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ময়নুল হক মুকুল। তিনি সেদিনের সেই ঘটনার কথা এভাবে বলেন, তখন দুপুর সাড়ে ১২টা হবে। হঠাৎ আমার নজর চলে যায় ভীমপুর গ্রামের দিকে। ভাল ভাবে তাকিয়ে দেখি কুন্ডলি পাকিয়ে ওই গ্রামের উপর ধোঁয়া উঠছে। আমি সবাইকে সেটা দেখতে বলি। ইতোমধ্যে মাঠের মধ্যে গ্রামের উদ্দেশ্যে দৌড় দেয় আদিবাসীরা।
চৌমাসিয়ার মোড় থেকে গ্রামটি ভালভাবে দেখা যায়। আমিও আদিবাসীদের পিছু পিছু গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হই। ততক্ষণ সব কিছু শেষ। আমি মহসীন রেজা, শহীদ হাসান সিদ্দিকী স্বপনসহ আরো কয়েকজনকে খবরটা জানিয়ে দেই। তবে আমার কাছে অবাক লেগেছে সেদিন পুলিশের তৎপরতা দেখে।
অতিদ্রুত পুলিশ কিভাবে খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হলো। তখনই আমার ধারনা হয়েছিল পুলিশকে ম্যানেজ করেই ঘটনাটি ঘটিয়ে ছিল হাতেম-গদাই গং। পুলিশ সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে আলফ্রেডের লাশ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আমি আদিবাসীদের নিয়ে বাধা প্রদান করি। পুলিশকে বাধ্যকরি লাশের ময়নাতদন্তেরর জন্য।
মামলার বর্তমান অবস্থা: আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় তার ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় পুলিশ ৯১জন আসামীর নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। এর মধ্যে পলিশ কয়েক জন আসামীকে গ্রেফতার করে। ওই সময় নওগাঁ দায়রা জজ আদালতে মামলার সাক্ষী গ্রহন শুরু হয় এবং ৪১জন সাক্ষীর মধ্যে সেই সময় ১৩ জনের সাক্ষী গ্রহন সম্পন্ন হয়েছিল। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জননিরাপত্তা আইন বাতিল করে।
ওই সময় পলাতক শীতেষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাই (বর্তমানে প্রয়াত) ও হাতেম আলীসহ ৬০ জনের অধিক আসামী জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে মামলাটি হাইকোর্ট ৩ মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন। এরপর আসামীরা জামিনে বেড়িয়ে আসে।
এ মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাড. মহসীন রেজা জানান, বর্তমানে আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলাটি অ্যাপিলেড ডিভিশন শুনানী অন্তে নিস্পত্তি করে পুনঃরায় পূর্ণাঙ্গ শুনানীন জন্য হাই কোর্ট ডিভিশনে প্রেরন করেছেন।
আদিবাসী নেতারা যা বললেন: জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্র নাথ সরেন বলেন, আমি চাই আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলাটি সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে যতদ্রুত সম্ভব নিস্পত্তি করা হোক। মামলাটি দির্ঘ দিন ঝুলে থাকায় অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আসামীদের বিভিন্ন হুমকীর ভয়ে অনেক স্বাক্ষী ভীমপুর আদিবাসী পল¬ী ছেড়ে চলে গেছে।
নওগাঁ জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মহসীন রেজা বলেন, ভূমিহীন ও আদিবাসীদের দখলকৃত জমি তাদের ফেরৎ দিয়ে পূর্ণ নিরাপত্তাসহ তাদের পনর্বাসন করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ওই এলাকায় প্রচুর সরকারী খাস সম্পত্তি আছে। সেখানে আদিবাসী ও ভূমিহীনদের দখলে রয়েছে মাত্র ৩০ বিঘার মত।
বাসদ নওগাঁ জেলার আহবায়ক জয়নাল আবেদীন মুকুল আক্ষেপ করে বলেন, ২২ বছরেও ওই মামলার নিস্পত্তি হলো না। অথচ বিষয়টি ছিল স্পর্শকাতক।
১৮ আগস্টের কর্মসূচি: এতসব আশংকার মধ্যেও ১৮ আগস্ট পালিত হবে নিহত আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনের ২২তম মৃত্যু বার্ষিকী।


প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২২ | সময়: ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ