রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাড়তে পারে যেসব পণ্যের দাম

সানশাইন ডেস্ক: করোনাভাইরাস মহামারির বিপর্যয় এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিশ্ব অর্থনীতি। এর মধ্যেই নতুন এক যুদ্ধে আবারও উত্তপ্ত বিশ্ব। যুদ্ধ দুপক্ষের কারও জন্যই সুফল বয়ে আনে না। যুদ্ধে প্রাণক্ষয় যেমন হয়, তেমনি জীবিত মানুষেরও দুর্ভোগের শেষ থাকে না। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হতে হতেই আবারও নতুন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে বিশ্ব।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ইতোমধ্যে ব্যারেলপ্রতি ১০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। যা গত সাত বছরেরও বেশি সময় পরে এই প্রথম। এখন যা ঘটে চলেছে, তাকে ‘তেলসংকট’ বলাই ভালো। সেই সঙ্গে প্রকট হয়ে উঠেছে ‘গ্যাসসংকট’। পাশাপাশি এক বছরের সর্বোচ্চে স্বর্ণের দাম। এ ছাড়া, রুপার দামও সাত মাসের সর্বোচ্চ বিন্দু স্পর্শ করেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জড়ালেও এর প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়েই। এর ফলে যেসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে এমন তালিকা করেছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। খাদ্যমূল্য: খাদ্য সরবরাহে বড় ধরনের সংকট হওয়ার শঙ্কা আছে। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশের বেশি গমের সরবরাহ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। আর বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি সূর্যমুখী তেল সরবরাহ করে ইউক্রেন। তবে গমের ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য রুটি। দেশে গত কয়েক মাসে কেজিপ্রতি আটার দাম ১০ টাকার মতো বেড়েছে। এর প্রভাবে বেকারি পণ্যের দামও বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে গমের সরবরাহ বিঘ্নিত হলে দেশে গমের দাম আরও বাড়তে পারে।
জ্বালানি: খাদ্যের পর জ্বালানির ওপরও ব্যাপক প্রভাবা পড়বে। অনেক ইউরোপীয় দেশ রাশিয়ার জ্বালানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বিশেষ করে রাশিয়া থেকে গ্যাস সরবরাহকারী বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পাইপলাইনের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এই নির্ভরতার ওপর ভিত্তি করে সংকটের প্রতি বিভিন্ন দেশের মনোভঙ্গি নির্ধারিত হয়। রাশিয়ার জ্বালানির ওপর এই নির্ভরশীলতার কারণে ইউরোপীয় দেশগুলো তাকে এখনই আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থা সুইফট থেকে বিচ্যুত করতে চায় না। তবে জার্মানি ইতিমধ্যে নতুন বাল্টিক গ্যাস পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম-২-এর কাজ স্থগিত করেছে।
রাশিয়া থেকে ইউরোপের গ্যাস সরবরাহ এখনই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে, এমন সম্ভাবনা কম। তবে এই সরবরাহে সামান্য ব্যাঘাত ঘটলেও বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। মহামারির কারণে বৈশ্বিক সংরক্ষিত গ্যাসের পরিমাণ ইতিমধ্যে অনেক কম, এখন নতুন করে সরবরাহ কমে গেলে বৈশ্বিক উৎপাদন অনেকটাই কমে যাবে। এতে শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাবে পড়বে ভোক্তাদের ওপর।
মাইক্রোচিপ: ২০২১ সালে সবচেয়ে বড় সংকটের ক্ষেত্র ছিল সেমিকন্ডাকটর ইন্ডাস্ট্রি বা মাইক্রোচিপ। অনেক বিশ্লেষক বলেছিলেন, ২০২২ সালে এ সংকট কেটে যাবে, কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে এ আশার বেলুন ফুটো হয়ে গেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ায় মাইক্রোচিপ সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিচ্ছে, অন্যদিকে মাইক্রোচিপের প্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন নিয়ন, প্যালাডিয়াম ও প্লাটিনামের অন্যতম উৎস হচ্ছে রাশিয়া। নিয়নের ৯০ শতাংশই জোগান দেয় রাশিয়া।
পরিবহন সংকট: জ্বালানির দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পায়-এটা অবশ্যম্ভাবী। তবে এই যুদ্ধের সঙ্গে আরও কিছু বিষয় জড়িত। ২০১১ সালে চীনের সঙ্গে রাশিয়ার রেল যোগাযোগ শুরু হয়। ইতিমধ্যে এই রুটে ৫০ হাজার ট্রেন চলাচল করেছে। তবে সম্প্রতি এই লাইন ইউক্রেন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে যুদ্ধের কারণে এ যোগাযোগ তেমন একটা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যতটুকুই হোক, তার প্রভাব সাধারণ মানুষের গায়ে লাগবে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি লোহা, নিকেল ও কপার উৎপাদিত হয় রাশিয়া ও ইউক্রেনে। এ ছাড়া, নিয়ন, প্যালাডিয়াম ও প্লাটিনামের মতো আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধাতু উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে যুক্ত এসব দেশ। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার এই হুমকির ভীতিতে ইতিমধ্যে এসব ধাতুর মূল্য বেড়ে গেছে। গত ডিসেম্বর মাসের পর প্যালাডিয়ামের দাম ইতিমধ্যে ৮০ শতাংশ বেড়েছে। গাড়ির ধোঁয়া নির্গমন ইউনিট থেকে শুরু করে মুঠোফোন, দাঁতের ফিলিং—এ রকম অনেক কিছুতেই প্যালাডিয়াম ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিমানশিল্প রাশিয়ার টাইটেনিয়ামের ওপর নির্ভরশীল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বোয়িং কোম্পানি ইতিমধ্যে বিকল্প উৎস থেকে টাইটানিয়াম সংগ্রহ শুরু করেছে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ধীরগতি: ভোক্তারা এত দিনের অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে দীর্ঘ সময় নেবেন এবং প্রবৃদ্ধির হার হবে মধ্যম মানের। সেই সঙ্গে মহামারির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে আরও বেশি সময় লাগবে। কিন্তু এ-ও মানতে হবে, অতীতের সঙ্গে তুলনা করতে বসলে দুর্ভাবনার মাত্রা অনেকখানি কম বলেই এ মুহূর্তে মনে হয়। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে খনিজ তেলের দাম দাঁড়িয়েছে ব্যারেলপ্রতি ১০০ মার্কিন ডলার, ২০১৩-১৪ সালেও যা ছিল এই ১০০ ডলার। এ কারণে সেই সময়ের নিরিখে দেখলে তেলের দাম যে অনেক বেড়েছে, এমনও নয়।
তবে যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি কমে যাবে। এমনিতেই করোনাভাইরাসের উপর্যুপরি ঢেউয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, সেই সময় যুদ্ধের কারণে পুনরুদ্ধার যে পিছিয়ে যাবে, তা বলাই বাহুল্য।


প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২২ | সময়: ৪:৩২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ