চতুর্থ দফায় আরও ১১৮ শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ

সানশাইন ডেস্ক: একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে তালিকা সরকার ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে, তাতে যুক্ত হল আরো ১১৮ জনের নাম।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক রোববার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তালিকা প্রকাশ করেন। এ নিয়ে চার দফায় মোট ৫৬০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম এল সরকারের তালিকায়। প্রথম দফায় ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালের ২৯ মে দ্বিতীয় তালিকায় আসে ১৪৩ জনের নাম। আর তৃতীয় দফায় এ বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি ১০৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামের গেজেট প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
রোববার চতুর্থ দফার তালিকা প্রকাশ করে মন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলেন, “আজকেই আমরা এই তালিকা গেজেট প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দেব। গেজেট প্র্রকাশের পর এই তালিকা আপনারা ওয়েবসাইটে পাবেন।” শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় যাদের নাম এসেছে, তাদের মধ্যে সাহিত্যিক রয়েছেন ১৮ জন, দার্শনিক একজন, বিজ্ঞানী তিনজন, চিত্রশিল্পী একজন, শিক্ষক ১৯৮ জন, গবেষক একজন, সাংবাদিক ১৮ জন, আইনজীবী ৫১ জন, চিকিৎসক ১১৩ জন, প্রকৌশলী ৪০ জন, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারি ৩৭ জন, রাজনীতিক ২০ জন, সমাজসেবী ২৯ জন, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক, সঙ্গীত, শিল্পকলার অন্যান্য শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৩০ জন রয়েছেন। স্থপতি ও ভাস্কর কাউকে পাওয়া যায়নি বলে জানান মন্ত্রী।
আগামী ১৪ ডিসেম্বরের আগেই চূড়ান্ত তালিকা করার লক্ষ্যের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আরো কিছু রিভিউ থাকে, কিছু রিভিউতে আছে। আমরা প্রাথমিকভাবে ৫৬০ তালিকার খসড়া দিলাম। সর্বশেষ ইনশাল্লাহ ১৪ ডিসেম্বরের আগে চূড়ান্ত তালিকা ঘোষণা করব। আজকে এটা আপনারা খসড়া তালিকা ধরে নিতে পারেন।”
শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞায় না পড়লেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত নাম মধুর ক্যান্টিনের ‘মধু দা’কে বুদ্ধিজীবীর তালিকায় রেখেছে সরকার। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতার কারণে বিশেষ বিবেচনায় তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় রাখা হয়েছে।
মোজাম্মেল হক বলেন, “বিশেষ বিবেচনায় যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধু দা। উনি এমন এক ব্যক্তি ছিলেনৃশিক্ষকও না, গবেষকও না, শিল্পীও না। উনি এমন এক ব্যক্তি সবাই তাকে চেনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনসহ যত আন্দোলন হয়েছে দেশের স্বাধীনতার জন্য, সেই রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনৃ যেখানে উনার যে অন্যন্য ভূমিকা ছিল। সেই হিসেবে বিশেষ বিবেচনায় অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে।
“মুধ দা সিম্পলি একজন চায়ের দোকানদার। বলতে পারেন উনি কীভাবে বুদ্ধিজীবী হয়? বাট উনার যে কনট্রিবিউশন (অবদান), সেই ২৩ বছরে যত নেতা যত কর্মী দেশের জন্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের সহযোগিতা করেছেন, উদ্ধুদ্ধ করেছেন, বিনা পয়সায় চা খাইয়েছেন। এই কারণে একটা ব্যতিক্রম। আমরা মধু দা ছাড়া কোনো ব্যক্তিক্রম করি নাই। এটা এক্মেপশন।”
এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সম্মান, স্বীকৃতি, সনদ প্রদান এবং তার নাম গেজেট প্রকাশ করা হয়। কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবার কোনো ভাতা রাষ্ট্র থেকে পায় না, কোনো আর্থিক সুবিধা তারা পান না। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সচিব ইশরাত চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে যখন পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারে, তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়, তখন তারা বাঙালিকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে অঙ্কুরেই দুর্বল করে দিতে এক হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তাদের বাসা থেকে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে।
এ গণহত্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত। বন্দি অবস্থায়ও বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ ঢাকার রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি। কারো কারো লাশের হসিদই মেলেনি।
এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে ১১ সদস্যের যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। এরপর দুটি উপকমিটি করা হয়। একটি কমিটির কাজ ছিল ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’র সংজ্ঞা নির্ধারণ করা। সেই সংজ্ঞা অনুসারে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম সংগ্রহ ও তা যাচাই–বাছাই করা অন্য কমিটির কাজ।
প্রথম কমিটির কাজ শেষে ২০২১ সালের ২১ মার্চ শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, যে সকল সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক, সংগীত ও শিল্পকলার অন্যান্য শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচিত হবেন।


প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২৪ | সময়: ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ