রাজশাহীতে বেড়েছে নির্বাচনি সহিংসতা

স্টাফ রিপোর্টার : নির্বাচনি প্রচারণা শুরু হতে না হতেই রাজশাহীর বিভিন্ন আসনে ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতা। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলার পাশাপাশি নির্বাচনি কার্যালয় ভাঙচুরের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একদিনে রাজশাহীর বাগমারা, দুর্গাপুর ও চারঘাটে অন্তত ১০টি নির্বাচনি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও বৃহস্প্রতিবার দুর্গাপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর আরেকটি নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়।
এসব আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অভিযোগে বলেছেন, নৌকার প্রার্থীদের কর্মী সমর্থকরা বেপরোয়া হয়ে নির্বাচনি প্রচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। ক্ষেত্রবিশেষে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের ওপর সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা করা হচ্ছে। পোস্টার কেড়ে নিয়ে পুকুরে নিক্ষেপ করার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
নির্বাচনি সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ এখন পর্যন্ত বাগমারা ও দুর্গাপুরের একটি ঘটনায় নৌকার ছয়জন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছেন। তবে অন্য ঘটনাগুলোর বিষয়ে পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের বিভিন্ন এলাকায় নৌকার প্রার্থী আবুল কালাম আজাদের কর্মী-সমর্থকদের হামলায় মঙ্গলবার একদিনেই ৬টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর বাগমারা নরদাশ ইউনিয়নের নরদাশ বাজারে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের কাঁচি প্রতীকের নির্বাচনি অফিসে হামলা করে নৌকা প্রার্থী কালামের কর্মী সমর্থকরা। দুইদিনে অন্তত ১০টি নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করে।
জানা গেছে, ঘটনার সময় স্বতন্ত্র প্রার্থী এনামুল হক এমপি ওই অফিসে নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। প্রার্থীর সামনেই তার নেতাকর্মীদের বাঁশ ও লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ৬ কর্মী আহত হন। হামলাকারীরা নির্বাচনি অফিসের চেয়ার টেবিল ভাঙচুর ও পোস্টার লুট করে নিয়ে যায়।
অন্যদিকে মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে উপজেলা সদর ভবানীগঞ্জ বাজারের গোডাউন মোড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী এনামুলের কাঁচি প্রতীকের নির্বাচনি অফিসে হামলা করে নৌকা প্রার্থীর একদল সশস্ত্র কর্মী। তারা নির্বাচনি অফিস ভাঙচুর ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থীর ৭ কর্মীকে পিটিয়ে আহত করে। আহতদের উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে।
এর আগে মঙ্গলবার দিনের বেলায় বাগমারার মাড়িয়া ইউপির যাত্রাগাছি, গোবিন্দপুর ইউপির হাটদামনাশ বাজার, তাহেরপুর পৌরসভার অর্জুনপাড়া ও গণিপুর ইউনিয়নের আঁচিনঘাট এলাকায় কাঁচি প্রতীকের গাড়ি ও প্রচার মাইক ভাঙচুর, পোস্টার কেড়ে নিয়ে পুকুরে ফেলে দেওয়া এবং ১৮ কর্মীকে পিটিয়ে আহত করে নৌকা প্রার্থী কালামের কর্মী সমর্থকরা।
এসব ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে গাড়িচালক এমরান হোসেন বাদী হয়ে বাগমারা থানায় দুইটি মামলা করেছেন। তবে এসব নির্বাচনি সহিংস ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
অব্যাহত নির্বাচনি সহিংসতা প্রসঙ্গে রাজশাহী-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক বলেন, নৌকার প্রার্থী আবুল কালাম আজাদসহ তার অনুসারীরা আমার কর্মী সমর্থকদের ওপর হামলা অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যে কাঁচি প্রতীকের ১০টি নির্বাচনি ক্যাম্প ভাঙচুর করা হয়েছে। পোস্টার টাঙাতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। টাঙ্গানো পোস্টার ব্যানার ছিড়ে ফেলা হচ্ছে। শান্তির বাগমারায় সন্ত্রাসের রাজ্ব কায়েম করার চেষ্টা করছে নৌকার প্রার্থী।
তিনি বলেন, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনসহ নির্বাচনি শৃঙ্খলা কমিটিতে অভিযোগ দিয়েছি কিন্তু কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। বাগমারা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। নৌকা প্রার্থীর কর্মীরা বেপরোয়া হয়ে বিভিন্ন স্থানে আমার নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে নির্বাচনি কোনো পরিবেশ থাকবে না।
এদিকে, রাজশাহী-৪ আসনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজ্জ্বল হোসেন জানান, ইতোমধ্যে কিছু বিশৃঙ্খলার ঘটনার বিষয়ে অভিযোগ এসেছে। এসব বিষয়ে পুলিশকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রার্থী যেই হোক, কোনো প্রকার সহিংসতা করতে দেওয়া হবে না।
অন্যদিকে রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের দুর্গাপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থী ওবায়দুর রহমানের ঈগল প্রতীকের পোস্টার কেড়ে নিয়ে তিন কর্মীকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় রাতেই দুর্গাপুর থানায় একটি মামলা হলে পুলিশ নৌকা প্রতীকের তিন কর্মী সাখাওয়াত হোসেন লায়ন (৩৪), জয় হোসেন (২৬) ও মাড়িয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক মোহা. রাসেলকে (২৫) গ্রেপ্তার করেছে।
রাজশাহী-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ওবায়দুর রহমান অভিযোগে বলেন, মঙ্গলবার দিনগত রাত ৮টার দিকে দুর্গাপুর উপজেলার মাড়িয়া ইউপির সাইফুলের মোড়ে আমার কর্মী-সমর্থকরা ঈগল প্রতীকের পোস্টার টাঙাচ্ছিলেন।
এ সময় নৌকার প্রার্থী আব্দুল ওয়াদুদ দারার কর্মী সাখাওয়াত হোসেন লায়ন, তার ভাই জয় ও ছাত্রলীগ নেতা রাসেলসহ ৭-৮ জন পোস্টার কেড়ে নিয়ে ঈগল প্রতীকের কর্মী আব্দুর রাজ্জাকসহ তিনজনকে পিটিয়ে জখম করে। এর মধ্যে গুরুতর জখম রাজ্জাককে প্রথমে দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এবং অবস্থার অবনতি হলে পরে রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মেহেদী হাসান বাদী হয়ে স্থানীয় থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
এদিকে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনের শলুয়া ইউনিয়নের বামনদীঘা বাজারে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাহেনুল হকের কাঁচি প্রতীকের নির্বাচনি অফিস ভাঙচুর ও একই সময়ে মালেকের মোড় এলাকায় কাঁচি প্রতীকের প্রচার গাড়ি ও মাইক ভাঙচুর করে নৌকার প্রার্থী শাহরিয়ার আলমের কর্মী সমর্থকরা।
স্বতন্ত্র প্রার্থী রাহেনুল হক বলেন, প্রচার শুরুর পর থেকেই নির্বাচনি এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে। আমি ইতিমধ্যে নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্বাচনি শৃঙ্খলা কমিটির কাছে অভিযোগ করেছি। নৌকার কর্মী সমর্থকরা বেপরোয়া হয়ে তার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা থেকে শুরু করে কর্মী সমর্থকদের অব্যাহতভাবে হুমকি দিচ্ছে।
এদিকে রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শারমিন আক্তার নিপা মাহিয়া মাহি অভিযোগে বলেন, প্রতীক পেয়েই তিনি এলাকায় ভোট প্রচারে নেমেছেন। তিনি তানোরের কামারগাঁও এলাকায় ট্রাক প্রতীকের নির্বাচনি অফিসের জন্য জনৈক রুবেলের ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন; কিন্তু নৌকার প্রার্থীর লোকজন রুবেলকে ভয়ভীতি দেখিয়ে হুমকি দিয়েছেন যেন আমাকে ঘর ভাড়া না দেওয়া হয়। তানোর ও গোদাগাড়ীতে আমাকে নির্বাচনি অফিস করতে বাধা প্রদান করা হচ্ছে।
অন্যদিকে রাজশাহী-১ আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম রাব্বানীর কাঁচি প্রতীকের নেতাকর্মীদেরকে প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গোলাম রাব্বানীর ভাই সাবেক যুবলীগ নেতা শরিফুল ইসলাম বলেন, গত সোমবার তানোর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল বাসার সুজন তানোরের তালোন্দ বাজারে এক প্রচার সভায় রাব্বানীর নেতাকর্মীদের পা ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম রাব্বানী বলেন, আমার কর্মী-সমর্থকদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমি নির্বাচনি শৃঙ্খলা কমিটিতে অভিযোগ করব।
অব্যাহতভাবে নির্বাচনি সহিংসতা প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা রিটার্নিং অফিসার ও জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, কিছু কিছু ঘটনায় ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভায় প্রার্থীদের আচরণবিধি ও নির্বাচনি শৃঙ্খলা মেনে চলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। শৃঙ্খলা পরিপন্থি সব ঘটনা আমলে নেওয়া হয়েছে।


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২২, ২০২৩ | সময়: ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর