পরিযায়ী পাখির কাকলিতে মুখরিত জবই বিল

সাপাহার প্রতিনিধি: পৌষ মাসের শীত আসতে এখনও মাসখানেক বাঁকি শীত শুরুর প্রারাম্ভেই নওগাঁ জেলাধীন সীমান্ত ঘেঁষা সাপাহার উপজেলার ঐতিহ্যবাহী জবই বিলে পরিযায়ী পাখির আগমন শুরু হয়েছে। বেশ কিছুদিন হল সরকারীভাবে বিলে মাছ শিকার করা বন্ধ রয়েছে ফলে বিলে জনবলের উপস্থিতিও রয়েছে কম।
তাই বাহির দেশ হতে পরিযায়ী পাখিরা শীত জেঁকে বসতে না বসতেই জবই বিলে আসা শুরু করে দিয়েছে। সারা বিল এখন দেশী বিদেশী পাখির আনাগোনায় মুখরিত হওয়া শুরু হয়েছে।
আগামী ডিসেম্বর মাসের প্রথম অথবা দ্বিতীয় সপ্তাহে এই বিল মৎস্য শিকারের উদ্বোধন করা হবে বলে সাপাহার উপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুল্যাহ আল মামুন জানিয়েছে। মাছ ধরার জন্য বিলটি উম্মুক্ত করে দেয়া হলে বিলে মানুষের উপস্থিতি ও সমাগম প্রচুর হলে আগত এই পরিযায়ী পাখির সংখ্যা অনেকাংশে কমে যেতে পারে বলে পাখি প্রেমিকরা মনে করছেন।
তবে এই বিলে যাতে সারা বছর পাখি থাকতে পারে সে জন্য এবারেই বিলের ভুতকুড়ী অংশে পাখির জন্য একটি অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হবে বলেও নির্বাহী অফিসার জানিয়েছেন।
সাপাহার উপজেলার ঐতিহ্যবাহী জবই বিলের জীববৈচিত্র্যের পটভুমিতে বলা হয়েছে বিলটি সাপাহার উপজেলা সদর হতে প্রায় ১৩ কি.মি পশ্চিমে অবস্থিত, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ বিল। জবই নামক গ্রাম পেরিয়ে এই বিলের অবস্থান তাই লোক মুখে জবই বিল নামে পরিচিতি পেয়েচে এ বিল। প্রকৃত পক্ষে এই বিলের নাম ডুমরইল, বোরা মির্জাপুর, মাহিল ও কালিন্দর চার বিলের সমন্বয়ে এই জবই বিল। বিলের উত্তরে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা দক্ষিণে ভারত ঘেঁষা পূণর্ভবা নদী।
এই বিলের আয়োতন প্রায় ১৫শ হেক্টোর। ভরা বর্ষা মৌসুমে এর পরিধি বিস্তার লাভ করে প্রায় ২ হাজার হেক্টরে পরিণত হয়। সরকারী হিসেব মতে বিলে খাস জমির পরিমান ৪০৩ হেক্টোর। অতিতে এলাকায় জনবসতি কম থাকায় সারা বছর ধরে বিলটি প্রকৃতিক কচুরীপানা, দল দামে ভরে থাকত। সেসময়ে সারা বছর ধরে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরাও বাস করত এই বিলে।
কালের বিবর্তনে এলাকায় ঘন জনবসতি গড়ে উঠায় পরবর্তীতে বিলের সকল কচুরীপানাগুলি সরিয়ে মানুষ বিলের নিম্নাংশে চাষাবাদ শুরু করে দেয় ফলে বিলের পাখির উপস্থিতি একেবারে শূন্যের কোঠায় দাড়ায় এবং বিগত কয়েক বছর ধরে বিলটি পাখি শূন্য অবস্থায় পড়ে থাকে।
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই বিলের নানাময় সম্ভাবনা দেখে ২০১৮ সালের দিকে স্থানীয় কিছু তরুণদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থা নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে বিলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কাজ শুরু করেন।
তারা প্রথমে উপজেলা প্রশাসন পরে স্থানীয় সাংসদ বর্তমান সরকারের খাদ্র মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সহায়তায় এলাকায় বিভিন্ন সভা সমাবেশ শুরু করেন। তাদের এ কাজে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ রাজশাহী ও যোগ দিয়ে কাজের গতিবিধি আরোও বৃদ্ধি করেন ও সেবছর হতেই তারা বিলের পাখি শুমারী বা জরিপ কার্যক্রম শুরু করেন।
জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংস্থার লোকজন ও সভাপতি সোহানুর রহমান সবুজ জানিয়েছেন বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী এই বিলে পাতি-সরালি, লাল ঝুটি-ভুতিহাস, গিরিয়া হাস, তিলি হাঁস, টিকি হাঁস, পিয়াং হাঁস, ঠেঙ্গি হাঁস, চা পাখি, বেগুনী বক, বাজলা বক, শামুখ খোল, মাছ মুরাল, সাপ পাখি, চখা চখি, হরেক রকম হাঁসের আনাগোনা শুরু হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে বিলটি পাখির সমাহারে সারা বিল ভরে উঠবে।
তাদের জরিপ মতে গত ২০১৯ সালে এবিলে দেশী বিদেশী মিলে মোট পাখির সংখ্যা ৫ হাজার ৫৯৩টি, ২০২০ সালে ৭ হাজার ৬৮৩টি, ২০২১ সালে ৯ হাজার ৭১২টি এবং ২০২২ সালে বিলে মৎস্যশিকারীদের ব্যাপক দাপাদাপিতে পাখির সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৬৯২টিতে। ২০২৩ সালের পাখি জরিপ কাজ চলমান প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংস্থার সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান জানিয়েছেন।
তিনি জরিপ কার্য চালাতে গিয়ে এবছর বিলে ছোট মাছের সংখ্যা অত্যাধিক বেশি তাই অনেক আগে থেকেই বিলে পাখির আগমন ঘটেছে বলে তিনি ও তার সংগঠনের লোকজন জানিয়েছেন। অতিতে এই বিল হতে প্রচুর পাখি শিকার হয়ে থাকলেও বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসন ও জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংস্থার হস্তক্ষেপে পাখি শিকার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে ঐতিহ্যবাহী জবই বিলে মৎস্য শিকারীদের দাপা দাপিতে অনেক পরিযায়ী পাখিরা কিছু দিন বিলে অবস্থান করার পর আবার বিল হতে চলে যাবে তাই বৃহৎ এই বিলের কোন একাংশে পাখিদের জন্য একটি অভয়াশ্রম গড়ে তুললে হয়তো সারা বছরই পাখির কলকাকলিতে বিলটি মুখরিত হয়ে থাকত বলে এলাকার পাখি প্রমিক ও জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংস্থার সভাপতি সোহানুর রহমান সবুজ দাবী করেছেন।
এলাকাবাসী বিলটি পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে একটি পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে সরকারের খাদ্র মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।


প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২৩ | সময়: ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ