২৮ অক্টোবর ঘিরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চরমে

সানশাইন ডেস্ক : ২৮ অক্টোবর ২০০৬। ইতিহাসের ভয়াল এক দিন। যারা সেদিনের ঘটনা দেখেছেন, মনে হলে এখনো আঁতকে ওঠেন তারা। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দিনে-দুপুরে বর্ণনাতীত নৃশংসতা দেখেছে বিশ্ব। লগি-বৈঠা নিয়ে একদল রাজপথে নেমেছিল সরকার হটাতে, আরেক দল প্রস্তুতি নিয়েই ঠেকাবার জন্য ছিল মাঠে। দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের পরিণতি হয় ভয়াবহ। ১৭ বছর পর, ফের ২৮ অক্টোবর। ফের রাজপথে নামছে দুই পক্ষ। আতঙ্ক তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। সমস্যা সমাধানে রাজপথ ছেড়ে আলোচনার টেবিলে বসার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।
সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায়ে ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ ডেকেছে বিএনপি। এরই মধ্যে জামায়াতও শাপলা চত্বরে সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে। জবাবে আওয়ামী লীগও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে কর্মসূচি দিয়েছে শান্তি সমাবেশের। নির্বাচনকালীন সরকারের ৯০ দিন শুরুর আগ মুহূর্তে এসব কর্মসূচি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে সব মহল। বিএনপির ঢাকায় ‘বসে পড়া’র ভয় তাড়া করছে সবাইকে। কারণ ২ কোটি মানুষের এ শহরে রাস্তা বন্ধ করে বসে পড়লে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
এরই মধ্যে বিএনপি ও সমমনাদের রুখে দিতে মাঠে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এদিন ঢাকায় ১০ লাখ লোকের সমাগম করে বিএনপির রাজনৈতিক কবর রচনার হুমকি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। পাশাপাশি ঢাকা দখল করতে এলে ‘প্যাদানি দিয়ে’ বুড়িগঙ্গা পার করে দেওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দলটির নেতারা। বুধবার এ নিয়ে দলটির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, উত্তর ও আশপাশের জেলার নেতাদের সঙ্গে বসছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।
এ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, বিএনপি নামক দলটি মাহুত ছাড়া পাগলা হাতি। তাদের নেতৃত্বের ঠিক নেই। এটি যে কার কথা মতো চলছে, এটা কেউ বলতে পারবে না। তাদের আন্দোলনের অতীত অভিজ্ঞতা হলো সহিংসতা। এখনো বিএনপির ওপর বিশ্বাস করা যায় না। তারা কী চায়? মানুষের মধ্যে কিন্তু আতঙ্ক আছে। তারা যে কথা বলছে, বা চাউর আছে- তারা ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বসে পড়বে বা শহরকে কলাপস করে দেবে। এটা হলে তো জনজীবন বিপর্যস্ত হবে।
‘তারা চায়, এ সরকারকে উৎখাত করতে। এ সরকার তো সামরিক সরকার না। জনগণের দল আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ সরকারকে উল্টে ফেলে দেওয়ার শক্তি কারো নেই। গত ১৫ বছরে এত পরিকল্পনা করেছে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। আগামী ২৮ তারিখের আন্দোলন সফল করতেও শত কোটি টাকা খরচ করেছে। আমার বিশ্বাস, এটিও ফানুসে পরিণত হবে। ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।’
আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রপ্রিয় শক্তিশালি বিরোধী দল চাই। কিন্তু বিএনপি সঠিক পথে হাঁটছে না। তারা যে পথে হাঁটছে, সে পথে তাদের মরণ অনিবার্য। যদি তারা কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, নির্বাচন বা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তাহলে আওয়ামী লীগেরও অধিকার আছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য রুখে দাঁড়াবার। আমরা তাদের রুখে দেবো।’
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, বিএনপি জামায়াতের এ আলটিমেটাম নতুন নয়। এর আগেও তারা আলটিমেটাম দিয়েছিল। খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলা চলমান অবস্থাতেও মামলা প্রত্যাহারের জন্য তারা আলটিমেটাম দিয়েছিল। ২০১৪-১৫ সালেও আলটিমেটাম দিয়েছে। গেল বছরের ১০ ডিসেম্বরেও তারা ঘোষণা দিয়েছিল। এগুলো মানুষ এখন আর বিশ্বাস করে না। এ নিয়ে দেশের মানুষের কৌতুহল নেই।
তিনি বলেন, তিনটি রাজনৈতিক দলেরই তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করার অধিকার আছে। কিন্তু যদি রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে, বা সরকার পতনের নামে কোনো সহিংসতা করে বা নাশকতা করে, তাহলে সরকার কঠোর অবস্থানে যাবে। বিএনপি নামক দলটি মাহুত ছাড়া পাগলা হাতি। তাদের নেতৃত্বের ঠিক নেই। এটি যে কার কথা মতো চলছে, এটা কেউ বলতে পারবে না।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ২৮ অক্টোবর নিয়ে হুমকি, ধামকিতে আওয়ামী লীগ বিচলিত নয়। সেদিন রাজপথে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি থাকবে। যেকোন ধরনের অরাজনৈতিক উদ্যোগ প্রতিহত করা হবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের ওপর অর্পিত আইনানুগ দায়িত্ব পালন করবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবেদিন ফারুক বলেন, আমাদের প্রস্তুতি তো আপনাদের বলবো না। আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ফাইট করছি কৌশলে। আমাদের নেতা তারেক রহমান কৌশলে এগিয়ে আছেন। সেজন্য জনগণের সমর্থনে এগিয়ে আছি, আন্দোলনেও এগিয়ে আছি, জনগণকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছি। তারা (আওয়ামী লীগ) যে ধমক-টমক দিচ্ছে, এগুলো আমরা কর্ণপাত করবো না। আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করবো। আমাদের ২৮ তারিখের মহাসমাবেশ নির্ধারিত স্থানেই সফল করবো। কে কোথায় করলো, আমাদের দেখার বিষয় নয়। তবে আমাদের ওপর আঘাত আসলে আমরা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবো।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, বিএনপি সারাদেশে গণকর্মসূচি চালিয়েছে। ২৮ তারিখেও বিএনপি মহাসমাবেশ ডেকেছে। সারাদেশ থেকে মানুষ আসবে। মানুষের ভোটের অধিকারের দাবি সরকারের কানে যাবে। সরকার নিশ্চয়ই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, জনগণ যেন ভোট দিতে পারে। সরকার যদি ২৮ অক্টোবর দাবি মেনে না নেয়, তাহলে আওয়ামী লীগ ৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন করেছিল, যা যা করেছিল, বিএনপিও তাই করবে।
উদ্ভূত সংকটের সমাধানে বিশিষ্টজনরা বলছেন, এ পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায়ী রাজনীতিবিদরা। তাদেরই এটির সমাধান করতে হবে। সংকটের সমাধান রাজপথ দখল করে হবে না, আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। ২৮ অক্টোবর তিন দলের কর্মসূচি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, সংঘাত হতেই পারে। সেখানে সাধারণ মানুষের কোনো যোগাযোগ থাকবে না। টাকা দিয়ে যাদের আনা হবে রাস্তায়, তারাই তাদের মধ্যে গণ্ডগোল করবে। এতে সাধারণ মানুষের আতঙ্কের কিছু নেই। সাধারণ মানুষ বাসা থেকেই বের হবে না।
সারাদেশ থেকে মানুষ আসবে। মানুষের ভোটের অধিকারের দাবি সরকারের কানে যাবে। সরকার নিশ্চয়ই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, জনগণ যেন ভোট দিতে পারে। সরকার যদি ২৮ অক্টোবর দাবি মেনে না নেয়, তাহলে আওয়ামী লীগ ৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন করেছিল, যা যা করেছিল, বিএনপিও তাই করবে। রাজনৈতিক সংঘাত এড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংঘাত তো রাজনীতিকরা বুঝবে। রাজনীতিকরা নিজেদের কথা ভাবে, সাধারণ মানুষের কথা ভাবে না, ভাবলে দুই দল মিলে রাস্তা বন্ধ করতো না। যার কারণে এই অবরোধ কর্মসূচি এবং তার প্রতিরোধের কর্মসূচি। অবরোধের কর্মসূচি না দিলে প্রতিরোধের ব্যাপার আসতো না। আবার আওয়ামী লীগ যখন জনসমাবেশ করবে, তারও প্রতিরোধ করবে। রাজনীতিকে এ পর্যায়ে নিয়ে আসার দায় রাজনীতিবিদদের, সাধারণ মানুষের নয়। সাধারণ মানুষ খুবই ত্যক্ত-বিরক্ত। শহরটা এমনিতেই অচল। তারপরও তারা সম্পূর্ণরূপে অচল করে দেয়, এটি কাম্য নয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এক দল আন্দোলনের মাঠে কর্মসূচি দিয়েছে। আরেক দল যদি এটা প্রতিহত করার জন্য মাঠে নামে। তাহলে সংঘাতের শঙ্কা দেখাই দেয়। আপনি যদি আগুন দিয়ে আগুনকে প্রতিহত করতে চান, তাহলে আপনাকে ছাই-ভষ্ম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এটাই বাস্তবতা। তবে এ পর্যন্ত আমরা যেটা দেখেছি, বিরোধী দল চেষ্টা করেছে অহিংস থাকতে, সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে। আমরা আশা করবো যে, পুলিশ যদি বাড়াবাড়ি না করে, সরকারের পক্ষ থেকে যদি ভূমিকা না নেওয়া হয়, তাহলে শান্তিপূর্ণই হবে। আর শান্তিপূর্ণ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কারণ সহিংসতা হলে সবারই ক্ষতির কারণ হবে।
এ পর্যন্ত আমরা যেটা দেখেছি, বিরোধী দল চেষ্টা করেছে অহিংস থাকতে, সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে। আমরা আশা করবো যে, পুলিশ যদি বাড়াবাড়ি না করে, সরকারের পক্ষ থেকে যদি ভূমিকা না নেওয়া হয়, তাহলে শান্তিপূর্ণই হবে। তিনি বলেন, সমাধানের পথ রাজপথ নয়, আলোচনার টেবিল। শুভবুদ্ধি, নীতিনৈতিকতাবোধ, দেশপ্রেম ইত্যাদি প্রদর্শন করলেই আমরা এ থেকে মুক্তি পাবো।
এদিকে, আগামী ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপির মহাসমাবেশের দিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের তরফ থেকে সেটা হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক থাকে, কোনো ধরনের জনজীবন যাতে ব্যাহত না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলেছি।


প্রকাশিত: অক্টোবর ২৬, ২০২৩ | সময়: ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ