সর্বশেষ সংবাদ :

ঘুষের নির্দেশনা দিলেন নাজিরপুরের এসিল্যান্ড, আছে দুর্নীতির অভিযোগও

সানশাইন ডেস্ক: জেলার নাজিরপুরে এসিল্যান্ড কর্তৃক তহশিলদারদের ঘুষ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া অডিও ভাইরাল হয়েছে। একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিরও অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী ও উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের (তহসিলদার) নিয়ে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে এসিল্যান্ড ও তহসিলদারদের মধ্যে ঘুষ নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়।
অডিওতে মো. মাসুদুর রহমানকে বলতে শোনা যায়, আপনারা যে অভিযোগ বা মকদ্দমা নিয়ে কাজ করেন, তা এনসিওর করার কোনো নিয়ম আছে? খোলামেলা কথা বলার জন্য এসিল্যান্ড তহসিলদারদের বলেন, আপনাদের মতামত শুনি যে আপনারা কি চাচ্ছেন? তিনি বলেন, এ ব্যাপারে শাখারিকাঠী ইউনিয়ন তহসিলদার মো. শাখাওয়াত সাহেবের সঙ্গে আমার সব বিষয়ে কথা হয়েছে।
অডিওতে শোনা যায়, মাটিভাঙ্গা ইউনিয়ন তহশিলদার মো. সুজন বলেন, দুই একরের বেশি জমি হলে তখন আমরা কত নিব? শ্রীরামকাঠী ইউনিয়ন তহশিলদার পরিমল বলেন, এটা স্যারের ওপর নির্ভর করে। আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবে আমরা নিব। তখন সদর ইউনিয়নের তহসিলদার শাহজাহান কবির বলেন, সব কেসে (অভিযোগ বা মকদ্দমা) যেমন এক, দুই বা তিন একর বাতার চেয়েও বেশি জমির ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত। যেমন পাঁচ হাজার ছিল। সেখানে আপনি বললে চার হাজারে নামিয়ে আনতে পারি। আপনি যেভাবে বলবেন।
তখন এসিল্যান্ডকে বলতে শোনা যায়, ধরেন, আমি চার হাজার নির্ধারণ করে দিলাম। আপনারা কত ডিল (চুক্তি) করবেন? প্রথমে মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের তহসিলদার মো. সুজন বলেন, এখানে যদি চার হাজার দেওয়া যায়, তা হলে মোট সাড়ে পাঁচ হাজার হলে হয়। আমার ছয় হাজারের বেশি নেব না।
নাজিরপুর সদর ইউনিয়নের তহসিলদার শাহজাহান কবির বলেন, এখানে চার হাজারসহ মোট ছয় হাজার টাকা হলে হয়। তখন এসিল্যান্ড বলেন, প্রতিটি নামজারির জন্য আমাকে চার হাজার, আপনারা দুই হাজারসহ মোট ছয় হাজার নিবেন বলে চূড়ান্ত করে দেন। এরপর আবার এসিল্যান্ড বলেন, বাস্তবে আপনারা কত টাকা নিতে চান বলেন। আমাকে চার হাজার করে দেন, আপনারা দেড় হাজার নিয়ে মোট সাড়ে পাঁচ হাজার করে দেন। তখন শেখমাটিয়া ইউনিয়ন তহসিলদার মো. হাসান হাওলাদার বলেন, স্যার এটা ছয় হাজার করা হোক।
এসিল্যান্ড ছয় হাজার টাকা করে প্রতিটি নামজারির জন্য চূড়ান্ত করে নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, ছয় হাজার টাকার ওপরে যেন না নেওয়া হয়। ‘খ’ তফসিলের নামজারির জন্য এসিল্যান্ড বলেন, আমাকে ‘ক’ তফসিলের প্রতিটি কেসের জন্য ১০ হাজার টাকা করে দিবেন আর আপনারা পাঁচ হাজার টাকা করে নিবেন। মোট ১৫ হাজার টাকা নিবেন।
উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, কোনো জমির মালিকানা পরিবর্তন হলে পুরানো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নতুন মালিকের নামে নামজারি করতে সরকারিভাবে ফি হিসেবে এক হাজার ১৭০ টাকা নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে দীর্ঘ দিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ভূমি অফিস তাদের চাহিদা মতো টাকা নিচ্ছেন। কিন্তু এবার এসিল্যান্ড কর্তৃক এমনভাবে ঘুষের টাকা নির্ধারণ করে দেওয়ায় সেবা প্রত্যাশীরা আগেও থেকেও বেশি হয়রানি হবে।
জানা গেছে, পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক এমপি একেএমএ আউয়ালের আমলে নাজিরপুর উপজেলা ভূমি অফিসের পেছনে খাস জমির ওপর একটি দ্বিতল পাকা ভবন তৈরি করা হয়। গত ২০২০ সালের দিকে তা নিয়ে দুদকে মামলা দায়ের হলে উপজেলা ভূমি অফিস তা দখলে নেয়। ওই ভবনসহ চারটি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সংস্কারের জন্য গত ৫ জুন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সাত লাখ ১১ হাজার ৪৬৭ টাকার টেন্ডারের মাধ্যমে ওই কাজ পায় ‘মেসার্স অহনা ট্রেডিং করপোরশন’ নামের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে করা এক আবেদনে জানা গেছে, এসিল্যান্ড ওই কাজ নিজে সুন্দরভাবে করার কথা বলে ঠিকাদারদের কাজ করতে দেননি। ঠিকাদারদের মাধ্যমে কাজের টাকা উঠিয়ে তিনি নিজের ব্যাংক হিসাবে রাখেন। গত ২২ জুন তিনি ‘সিটি ব্যাংক’ পিরোজপুরের একটি শাখা থেকে উপজেলা ভূমি অফিসের দুই কর্মচারীর মাধ্যমে নিজ এলাকার একটি ব্যাংক হিসাবে ছয় লাখ ১৭ হাজার টাকা পাঠান।
সরকারিভাবে জমির মিউটেশনের জন্য ই-নামজারি ব্যবস্থা থাকলেও সনাতনী পদ্ধতিতে মিউটেশন করা হচ্ছে। এতে স্থানীয় ভূমি অফিসের মাধ্যমে ঘুষ-দুর্নীতির সুযোগসহ সেবা প্রত্যাশীরা হয়রানির শিকার হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা ভূমি অফিসের এক কর্মচারী জানান, এসিল্যান্ড প্রায়ই কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে অফিসের গাড়ি নিয়ে জেলার বাহিরে যান। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গেলে বিষয়টি নজরে আসে বিভাগীয় কমিশনারের। এ নিয়ে তিনি এসিল্যান্ডের ওপর ক্ষিপ্ত হন।
এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার ভূমি (এসিল্যান্ড) মো. মাসুদুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, তিনি একটি পরীক্ষার জন্য ঢাকায় আছেন। বিষয়টি সাজিয়ে তাকে জড়ানো হয়েছে। এ সময় তিনি কোনো অপরাধ করেননি বলেও দাবি করেন। অডিও কথোপকথনের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ডাক্তার সঞ্জিব দাশ বলেন, অডিওর কথোপকথন শুনেছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। উল্লেখ্য, মো. মাসুদুর রহমান গত ৮ জুন জেলার নাজিরপুরে এসিল্যান্ড হিসেবে যোগদান করেন। এরআগে, তিনি সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।


প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৩ | সময়: ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ