মৎস্য অধিদপ্তরে গাড়ি নেই অথচ তেল-মবিলের খরচ ৮ কোটি!

সানশাইন ডেস্ক: মৎস্য অধিদপ্তরের পাঁচ বছরের একটি প্রকল্পে কোনো গাড়ি কেনা হচ্ছে না। কিন্তু গাড়ির মবিল কেনা বাবদ আট কোটি টাকার সংস্থান চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া একটি গাড়ি ভাড়া নেওয়া হবে। গাড়ির ভাড়া, চালক ও তেল খরচ বাবদ কোটি টাকার বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্পে ১০০ জনের বিদেশ ভ্রমণের জন্য সাত কোটি টাকার আবদারও করা হয়েছে। এগুলো বাদে প্রকল্পের আরও অনেক খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাবিত মৎস্য অধিদপ্তরের ‘বিদ্যমান সরকারি মৎস খামার ও বাঁওড়সমূহের সক্ষমতা ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পে এমন আবদার করা হয়েছে। প্রকল্পটির জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২৭ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে অধিদপ্তর। প্রকল্পটি চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অননুমোদিত নতুন প্রকল্পের তালিকায় উচ্চ-অগ্রাধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত আছে।
প্রকল্পের অধীনে দেশের মধ্যে ভ্রমণে ব্যয় হবে পাঁচ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। প্রকল্প অফিস, বিভিন্ন সভা ও মূল্যায়ন সভায় আপ্যায়ন বাবদ এক কোটি টাকা, ১২৪টি কর্মশালায় তিন কোটি ৫৭ লাখ টাকা, সীমান প্রাচীর নির্মাণ ও সংস্কারে ৭৬ কোটি টাকা খরচ হবে। এ ছাড়া সৌরবিদ্যুতের জন্য থোক বরাদ্দ থাকছে ৪২ কোটি টাকা। খামারের ইন্টারনাল রোড নির্মাণে খরচ হবে সাড়ে ৪৬ কোটি টাকা, বাঁওড় পুনঃখননে ১২৭ কোটি টাকা, ভবন নির্মাণে ২৫১ কোটি টাকা খরচ হবে। অনাবাসিক ভবন মেরামতে থোক বরাদ্দ ৩২ কোটি টাকা, মোটরযান মেরামতে সাড়ে চার কোটি টাকা এবং মেলায় অংশগ্রহণে প্রয়োজন হবে তিন কোটি টাকা
প্রকল্পের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, মৎস্য খামার আধুনিকীকরণ ও সরকারি বাঁওড় উন্নয়ন, প্রযুক্তি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে খামারে উন্নত মৎস্য প্রযুক্তি স্থাপন, উন্নত কৌলিতাত্ত্বিক গুণসম্পন্ন প্রজননক্ষম মাছ সংরক্ষণ এবং মৎস্য খামারে নিয়োজিত জনবলের কারিগরি সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দক্ষতার উন্নয়ন।
প্রকল্পের ডিপিপিতে দেখা গেছে, প্রকল্পের অধীনে দেশের মধ্যে ভ্রমণে ব্যয় হবে পাঁচ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। প্রকল্প অফিস, বিভিন্ন সভা ও মূল্যায়ন সভায় আপ্যায়ন বাবদ এক কোটি টাকা, ১২৪টি কর্মশালায় তিন কোটি ৫৭ লাখ টাকা, সীমান প্রাচীর নির্মাণ ও সংস্কারে ৭৬ কোটি টাকা খরচ হবে। এ ছাড়া সৌরবিদ্যুতের জন্য থোক বরাদ্দ থাকছে ৪২ কোটি টাকা। খামারের ইন্টারনাল রোড নির্মাণে খরচ হবে সাড়ে ৪৬ কোটি টাকা, বাঁওড় পুনঃখননে ১২৭ কোটি টাকা, ভবন নির্মাণে ২৫১ কোটি টাকা খরচ হবে। অনাবাসিক ভবন মেরামতে থোক বরাদ্দ ৩২ কোটি টাকা, মোটরযান মেরামতে সাড়ে চার কোটি টাকা এবং মেলায় অংশগ্রহণে প্রয়োজন হবে তিন কোটি টাকা।
এ খাতে শুধু মবিল অ্যান্ড লুব্রিকেন্ট থাকলেও বাস্তবে মবিল ও অয়েল ক্রয় করা হবে। মাঠপর্যায়ে যারা কাজ দেখাশোনা করবেন তারা তো মোটরসাইকেলে যাবেন। তাদের ফুয়েল লাগবে। জেলা ও উপজেলায় আমাদের যে গাড়িগুলো আছে সেগুলোর জন্য এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এটি সব প্রকল্পেই থাকে।
এ ছাড়া একটি গাড়ি ভাড়া, চালক ও তেল বাবদ এক কোটি আট লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। পাঁচ হাজার ৪৪০ জনের অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ বাবদ ১৫ কোটি টাকা, পেট্রোল ও লুব্রিকেন্ট বাবদ আট কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গ্যাস ও জ্বালানি খাত দেখিয়ে ৫০ লাখ টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ৫৬টি প্রদর্শনী খামার পরিচালনা বাবদ ১১ কোটি ৫১ লাখ টাকা, মাছের কৌলিতাত্ত্বিক উন্নয়ন ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা ব্যয় এক কোটি ৫৪ লাখ টাকা এবং পরামর্শকের জন্য সাত কোটি ৪৫ লাখ টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পে একটি গাড়ির ভাড়া, চালক ও তেল বাবদ এক কোটি আট লাখ টাকা চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এ প্রকল্পে সম্ভবত কোনো গাড়ি দেবে না। তবে, একটা গাড়ি ভাড়া করার সিদ্ধান্ত আছে। পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গাড়ি ভাড়ার বিষয়টি থাকছে।
মবিল ক্রয়ে কেন আট কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে- এমন প্রশ্নে মহাপরিচালক বলেন, ‘এ খাতে শুধু মবিল অ্যান্ড লুব্রিকেন্ট থাকলেও বাস্তবে মবিল ও অয়েল ক্রয় করা হবে। মাঠপর্যায়ে যারা কাজ দেখাশোনা করবেন তারা তো মোটরসাইকেলে যাবেন। তাদের ফুয়েল লাগবে। জেলা ও উপজেলায় আমাদের যে গাড়িগুলো আছে সেগুলোর জন্য এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এটা সব প্রকল্পেই থাকে।’
বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে তিনি বলেন, টেকনোলজি শেয়ার করার জন্য বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকারি অর্থায়নে আপতত বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ আছে। এটি আপাতত না হলেও অন্য সোর্স থেকে বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। হয়তো ভবিষ্যতে আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের এ বিষয়ে অনুরোধ করতে হবে। যেমন- জাইকাকে আমরা অনুরোধ করতে পারি। কারণ, বিদেশ থেকে প্রযুক্তি না আনলে তো আমাদের হবে না। এ জন্য সরকারি সোর্সে না হলে আমরা অন্য সোর্সে এটি খুঁজব।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের হ্যাচারিগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। ক্যাপাটিসির অর্ধেকও আমরা প্রডাকশন করতে পারি না। শুধুমাত্র জরাজীর্ণ হ্যাচারির কারণে। এ জন্য অনাবাসিক ভবন পুনর্র্নিমাণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ খাতে ৩২ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের যে খামারগুলো আছে, সেগুলোর ভেতরের রোডকে ইন্টারনাল রোড বলা হয়। ইন্টারনাল রোডের মেরামতের জন্য ৪৬ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। বর্তমানে প্রত্যেকটি খামারে যাওয়ার জন্য ছোট ছোট রাস্তা থাকে। এ অর্থে শতাধিক খামারের রাস্তা মেরামত করতে হবে।’
‘সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, প্রকল্পটি দুটি ফেজে ভাগ করে করার জন্য। আমরা এখানে প্রায় ১৪০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় নির্ধারণ করেছি। এখন পরিকল্পনা কমিশন বা সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্পটি দুটি পর্যায়ে করতে হবে। এ জন্য প্রকল্পটির ব্যয় কমে আসবে। এ ছাড়া এ প্রকল্পে বাঁওড়ের যে বিষয় আছে, সেটিও আপাতত বাদ যাবে। কারণ, বাঁওড়ের জন্য আলাদা একটি প্রকল্প করা হবে।’
প্রকল্পের আওতায় ১২ হাজার মানুষকে প্রশিক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তাবিত প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা কমিয়ে ব্যয় যৌক্তিক আকারে নির্ধারণ করতে চায় পরিকল্পনা কমিশন। কমিশন বলছে, ট্রেডভিত্তিক প্রশিক্ষণের কোনো মডিউল ডিপিপিতে সংযুক্ত করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মডিউল অনুসরণ করতে হবে।
এ ছাড়া সেমিনার/কনফারেন্সের জন্য এক কোটি ৭১ লাখ, অডিও ভিডিওর জন্য ৬০ লাখ এবং প্রচার ও বিজ্ঞাপনের জন্য ৬০ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলনের যৌক্তিকতা নিয়েও আলোচনা প্রয়োজন বলে মনে করে কমিশন। যেহেতু প্রস্তাবিত প্রকল্পে গাড়ি হায়ারিং (চুক্তিভিত্তিক) করা হবে সেহেতু পেট্রোল, অয়েল, লুব্রিকেন্ট, গ্যাস ও জ্বালানি এবং মোটরযান (মেরামত ও সংরক্ষণ) খাত বাদ দিতে হবে।
ডিপিপিতে ১০০ জনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণ/শিক্ষা সফরের জন্য সাত কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু অর্থ বিভাগ থেকে চলতি অর্থবছরে সব প্রকল্পে বৈদেশিক ভ্রমণ/ওয়ার্কশপ/সেমিনারে অংশগ্রহণ বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রস্তাবিত বৈদেশিক প্রশিক্ষণের বিষয়ে অর্থ বিভাগের মতামত গ্রহণ করা যেতে পারে।
কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের বন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উইংয়ের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মাদ মফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পিইসি সভায় প্রকল্পটির প্রতিটি খাত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। প্রকল্পের বিষয়ে মিটিংয়ে সিদ্ধান্তও হয়েছে। তবে, এখনও পিইসি সভার কার্যবিবরণী বের হয়নি। কার্যবিবরণী বের হলে সার্বিক বিষয়ের সিদ্ধান্তগুলো জানাতে পারব।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ‘থোক বরাদ্দ’ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রকল্পের সঙ্গে যারা জড়িত, অনিয়মের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা এ বরাদ্দ থেকে নিজেদের সুবিধা আদায় করে নেবে। থোক বরাদ্দ একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে থাকা যুক্তিযুক্ত হতে পারে। পাবলিক মানি মানেই জনগণের অর্থ। এ অর্থ কোন খাতে এবং কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে, সেটির একটি মাপকাঠি থাকা উচিত।’
বিদেশ ভ্রমণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী নিজেই একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছেন। এটি না মানা তো সরকারি নির্দেশের লঙ্ঘন। সরকারি নিয়োগবিধিমালা অনুযায়ী, এটি অপরাধ। যারা এটি করছেন, তারা অপরাধ করছেন। তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার। এ ছাড়া, এখানে একটি নৈতিকতারও প্রশ্ন থাকে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কিন্তু এ রকম একটি নির্দেশনা এসেছে। এটি চর্চা করাও দায়িত্ব। জনগণের অর্থে এ ধরনের প্রমোদভ্রমণের যৌক্তিকতা থাকে না।’
প্রকল্পে গাড়ি নেই কিন্তু মবিল কেনার জন্য আট কোটি টাকার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে- এমন চাওয়া কতটুকু যৌক্তিক? উত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তি আছেন, তাদের জ্বালানি দরকার। সেই কারণে খাতটি যুক্ত রাখা হয়েছে। এখানে ঢালাওভাবে বরাদ্দ রাখা হয়েছে।’


প্রকাশিত: আগস্ট ২৯, ২০২৩ | সময়: ৪:৫৮ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ