কেশরহাটে বালু ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা: পরিবারকে মামলা না করতে চাপ প্রভাবশালীদের

কেশরহাট প্রতিনিধি:
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার কেশরহাটে বিশিষ্ট ইট-বালু ব্যবসায়ীর আত্মহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকাবাসী ও নিহতের পরিবারের দাবি, একই এলাকার আলোচিত সুদ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলামের প্ররোচনায় ও অতিরিক্ত চাপে পড়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ইট-বালু ব্যবসায়ী কেশরহাট পৌরসভার বাকশৈল গ্রামের তমির কারিগরের ছেলে ইব্রাহিম কারিগর (৬১)। সুদ ব্যবসায়ী একই গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৩০)। গ্রামবাসীদের একটি সূত্র বলছে, আলোচিত সুদ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলামের পক্ষ নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে কৌশলে নিহত ইব্রাহিম কারিগরের বড় মেয়েকে সরে থাকতে বাধ্য করেছেন প্রভাবশালীরা।

 

 

 

 

 

প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে , সুদ ব্যবসায়ী সাইফুলের নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ননায় যা পাওয়া গেছে তাতে শিহরিত না হয়ে উপায় নেয়। জানা গেছে, ২ লক্ষ টাকা থেকে সুদসহ ১৪ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকা আদায়ে সাইফুল ইসলাম নিহত ইব্রাহিম কারিগরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ২ টি ট্রাকটর, ২ টি কাকড়ার চাবি, খাতাপত্র ও সিমেন্টের দোকান জোরপূর্বক কেড়ে নেয়। এছাড়াও সে ইট-বালুর ব্যবসা কেড়ে নিতে নানান পায়তারা শুরু করে। গত পহেলা মে ইব্রাহিম কারিগরের ব্যবসার নাম পরিবর্তন করে “ভাই ভাই হার্ডওয়্যার ষ্টোর” বিজ্ঞাপনে মালিক দাবি করে শ্রমিকদের মাঝে গেঞ্জি বিতরণ করেন আলোচিত সুদ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম। আর এর আগের ৩০ এপ্রিল দুপুর থেকে নিখোঁজ হন ইব্রাহিম কারিগর। এছাড়াও মিনিটে মিনিটে ফোন দিয়ে গালিগালাজ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নির্যাতন করার অভিযোগ করেন নিহত ইব্রাহিম কারিগরের পরিবার। সর্বোপরি ইব্রাহিম কারিগরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সহায় সম্পদ সবকিছু স্ট্যাম্পে লিখে নিতে চাপ প্রয়োগ করেন সুদ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম। সাইফুল ইসলামের এসব একেরপর এক অমানষিক নির্যাতন সয্য করতে না পেরে ২ টি কীটনাশক বিষ পান করে ও পরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন ইব্রাহিম কারিগর।

 

 

 

 

 

জানা গেছে, ইব্রাহিম কারিগরের দাফন শেষ হলে পরদিন সকালেই তার ইট-বালুর ব্যবসা দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন সাইফুল ইসলাম। পরে স্থানীয়রা এসে তা রক্ষা করে। বর্তমানে সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব পান ইব্রাহিম কারিগরের ছোট মেয়ে জামায় সুবহান আলী। আর খাতাপত্রসহ হিসেব-নিকেশ এর দায়িত্ব নেন কেশরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম।

 

 

 

 

 

 

সুদ ব্যবসায়ী সাইফুলের জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, কেশরহাট পৌর এলাকা পরিচিত সুদকারবারী সাইফুল ইসলামের বাবা সালামের জন্মস্থান কেশরহাট পৌর এলাকার রায়ঘাটী মহল্লায়। সালাম জীবন জীবিকা ও আশ্রয়ের জায়গা না থাকার কারণে তিনি ২৫ বছর আগে পৌর এলাকার বাকশৈল গ্রামে এক নারীকে বিয়ে ঘর জামাই হিসেবে বসবাস শুরু করেন। এই পরিবারে মাত্র ৬ শতাংশ খানাবাড়ির জমি ছাড়া কিছুই ছিলনা। এরপর তিনি নামে মাত্র সবজি ব্যবসার আড়ালে গাঁজা ও চৌলায় মদসহ ফেন্সিডিল বিক্রয় শুরু করেন। তিনি একাধিকবার প্রশাসনের জালে আটক হয়ে হাজতবাসে যান। চরম অভাব-অনটনে সংসারের হাল ধরতে সালামের ছেলে সাইফুল ইসলাম কেশরহাট বাজারের মাছ বাজারে টোকায় হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন। ছোট ছেলে হিসেবে সাইফুল প্রথমে ছুটসাঁট মাছ কুড়ানো, মাছ চুরিসহ কলাপাতা বিক্রয় শুরু করেন। তবে তিনি মাছ ব্যবসায় সম্পৃক্ত না হলেও নানীর দাদন ব্যবসার অনুকরণ করে দাদন ও সুদের ব্যবসা শুরু করেন। সামান্য ৭/৮ বছরের ব্যবধানে সেই সাইফুল বনে যান সদ্য কোটিপতি। তার কাছ থেকে চড়া সুদের দাদন নেয়া অনেক মানুষ আজ নি:স্ব।

 

 

 

 

 

গ্রামবাসীরা জানান, সাইফুল এলাকার বড় একজন সুদ ব্যবসায়ি। তার দেয়া সুদের টাকায় চলে অনেক মানুষের ব্যবসা বানিজ্য। নানীর সেইমাটির কুঁড়ে ঘরে থেকেই অল্প সময়েই কিনেছেন দুটি পাকা বাড়ি। নিজস্ব সম্পদ বাড়াতে একাধিক স্থানে কিনেছেন ভিটামাটি। বাকশৈল গ্রামের এক ব্যক্তিকে ৭টি বড় বড় গরু কিনে দাদন দিয়েছেন। যার আনুমানিক মূল্য ১৫ লাখ টাকা। এছাড়াও তার আরও ৪০/৪৫ টি গরু দাদনে রয়েছে বলে জানা গেছে।

 

 

 

 

ইব্রাহিমের মেয়ে সাকিলা জানান, তার বাবা আসলে আত্মহত্যা করেছে নাকি হত্যায় ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয়েছে। সেদিন আমার বাবাকে যদি সুদের টাকার জন্য দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লিখে নিতে বাধ্য করা না হতো তাহলে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতেন না। এবিষয় নিয়ে আমি প্রশাসনকে অবহিত করেছি। সহিদুল স্যারের পরামর্শে আমার ক্ষেত্র চাঁপাই নবাবগঞ্জে চলে এসেছি। সাইফুলের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করবো। সাইফুলকে আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনের কাছে দাবী জানাচ্ছি।

 

 

 

 

 

ব্রাহিমের ছোট মেয়ে জামাতা সুবহান আলী বলেন, আমি কয়েক বছর আগে সুদখোর সাইফুলের কাছে ১ লাখ টাকা নিয়ে সুদের উপর নিয়োমিত প্রতিমাসের সুদের টাকা দিয়েছি। নগদ ৭৫ হাজার টাকার পরিশোধ করার পরও সাইফুল আমার বিরুদ্ধে আদালতে সাড়ে ৪ লাখ টাকার মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় দীর্ঘদিন হাজত খেটে জামিনে মুক্তি পায়। আমার শ্বশুরকে সুদের টাকা নিতে অতিরিক্ত চাপ দেয়ায় তিনি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। এজন্য আমি তার বিচার দাবী জানায়।

কেশরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক সহিদুল ইসলাম বলেন, মৃত ইব্রাহিম আমার নিকট আত্মীয়। তার মৃত্যুর ঘটনার পরদিন তার দোকানসহ খাতাপত্র তসনস হওয়ার জন্য পৌর মেয়রের সহযোগিতায় তা রক্ষা করেছি।

 

 

 

 

 

 

জানতে চাইলে কেশরহাট পৌরসভার মেয়র শহিদুজ্জামান বলেন, সাইফুল সুদব্যবসা করে কিনা তা আমি জানিনা। ইব্রাহিমের লাশ দাফনের পরদিন সকালে সাইফুল লোকজন নিয়ে ইব্রাহিমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেয়ার চেষ্টা করছিল। আমাকে খবর দেয়া হলে নিজে গিয়ে দোকান তালাবদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে হিসাব-নিকাশের খাতাপত্র হেফাজতের দায়িত্ব নেয়ার ব্যবস্থা করেছি। সাইফুলের মতো আরো অনেক সুদ কারবারি রয়েছে এদের আইনের আনতে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করছি।

মোহনপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সেলিম বাদশাহ বলেন, ইব্রাহিমের মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্ত হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সানশাইন/সোহরাব


প্রকাশিত: মে ১২, ২০২৩ | সময়: ৯:৪৬ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine