বৃষ্টির ‘বিয়ে’ বাণিজ্য : প্রতারণার ফাঁদে বন্দি ডজনখানেক পুরুষ 

স্টাফ রিপোর্টার: 

খোরশেদা আক্তার বৃষ্টি (৩২) সংসারে নয়, বিয়ে করে অর্থ হাতানো ব্যবসা তার। গত ৭ বছর যাবত ডজন খানেক পুরুষকে কাগজে-কলমে ও কালেমা পড়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে করেছেন বিয়ে। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই হাতিয়ে নেন অর্থসহ বিভিন্ন স্থা বর-অস্থাবর। এরপর নিজেই ভাঙ্গন ধরান সংসারে। স্বেচ্ছায় বিচ্ছেদ ঘটিয়ে স্বামীদের কাছে হাতিয়ে নেন দেনমোহরানার অর্থ। বিয়ে বাণিজ্যের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে এখন রাজশাহীসহ বাইরের জেলার অনেকেই হয়েছেন নিঃস্ব।

 

 

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার শিয়ালবেড় এলাকার খুরশেদ আলমের মেয়ে এই বৃষ্টি। পারিবারিকভাবেই ২০০৪ সালে বৃষ্টির বিয়ে একই এলাকার জালাল উদ্দিনের ছেলে সেলিম রেজার সাথে তার। প্রথম স্বামীর সঙ্গে ১২ বছরের সংসারে হয়েছে ৩টি সন্তান। কিন্তু উচ্চাভিলাষি জীবন-যাপন, ফেসবুক ও টিকটকের ব্যবহার ও পরকিয়া প্রেমে আসক্তির কারণে ভাঙ্গন ধরে সংসারে। সংসার বিচ্ছেদের শুরু হয় বৃষ্টির বেপরোয়া জীবন। ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন মাদক সিন্ডিকেট, দেহ ব্যবসার সঙ্গে। এখন নিজেই পরিচালনা করেন প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে ও অন্তরঙ্গ মূহুর্তের ফুটেজ নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ হাতানোর একটি সংঘবদ্ধচক্র। একাজে ব্যবহার করেন ফেসবুক, টিকটকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী।

 

 

প্রাথমিকভাবে প্রেমের ফাঁদে ফেলে নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে টাকার জন্য চাপ দেন। তাতে কাজ না হলে করেন থানা কিংবা আদালতে মামলা। এভাবে বিয়ের পর তালাক দিয়ে এখনো বৃষ্টি হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রচুর অর্থবিত্ত।

 

 

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত প্রথম স্বামী সেলিম, বাগমারা নিবাসী বর্তমান স্বামী শরিফ, বড় বনগ্রামের রনি, চন্ডিপুরের জৈনক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এক মাদ্রাসা শিক্ষক, ছোট বনগ্রামের রনি, কুষ্টিয়ার ফিরোজ নামের এক বেসরকারি চাকুরিজীবী, মথুরডাঙ্গার টেইলার্সের ব্যবসায়ী ফয়সাল, বহরমপুরের সারোয়ার, নওদাপাড়ার মিলন, মাদ্রাসা শিক্ষক আবু বক্কর, মাদ্রাসা শিক্ষক রবিউল, রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জের সিদ্দিক, উপশহর এলাকার এক কোরিয়ান প্রবাসী, জনৈক সরকারি কর্মকর্তাসহ প্রায় ডজন খানেক ব্যক্তিকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হয়রানির মাধ্যমে অর্থ হাতাচ্ছেন বৃষ্টি। তার এ কাজে সহযোগিতা করেন বুলনপুরের সাব্বির নামের এক মহুরী। মহুরী সাব্বির বৃষ্টির প্রায় সকল বিয়ে পড়ানো ও তালাকের দেওয়া এবং দেনমোহরানার মধ্যস্থতার কাজ করেন তিনি।

 

 

 

শুধু ভুক্তভোগীদের কাছে থেকে অর্থ বা অন্যান্য সুবিধা হাতিয়ে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বৃষ্টি। এসকল ব্যক্তিকে ফাঁসিয়ে জিম্মাদার বানিয়ে ওয়াল্টন, এলজিসহ বিভিন্ন শো-রুম থেকে নিয়েছেন টিভি, ফ্রিজ, ওভেনসহ বিভিন্ন পণ্য। প্রথম কিস্তি দেওয়ার পর লাপাত্তা হন তিনি। এরপর দায়বদ্ধ ওয়ারেন্টার হিসেবে থাকা ব্যক্তিরা পড়েন বিপাকে। প্রতারণার মাধ্যমে হাতানো পণ্যগুলো পরে বিক্রিও করে দেন বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে। একাজে ব্যবহার করেন নিজের আসল জাতীয় পরিচয়পত্র সহ কিছু নকল পরিচয়পত্র। শো-রুম থেকে সংগ্রহ করা বৃষ্টির আসল ও নকল এনআইডি-ও রয়েছে প্রতিবেদকের সংগ্রহে।

 

 

 

এছাড়াও বছর দুয়েক আগেও নগরীর থিম ওমর প্লাজায় গোদাগাড়ীর সাংসদ এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর নিজস্ব শো-রুম থেকে শাড়ী চুরির সময় হাতে-নাতে ধরাও পড়েন বৃষ্টি। পরে এমপি ওমর ফারুক নিজেই বৃষ্টির বিরুদ্ধে শিরোইল পুলিশ ফাঁড়িতে একটি অভিযোগ করে পুলিশে সোপর্দ করেন। এতোকিছুর পরও সম্প্রতি বাগমারায় শরিফ নামের তার আরেক স্বামীর কাছে থেকে হাতিয়েছেন অর্থ। নিশ্চিন্তে বেপরোয়াভাবে বৃষ্টি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন রাজশাহীসহ আশপাশের জেলা-উপজেলা।

 

 

বৃষ্টির সংঘবদ্ধ প্রতারকক্রের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ কিংবা ন্যায়বিচারের আশায় অগ্রসর হলে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে প্রথমে হুমকি ও পরে মারধর করেন তিনি। তাঁতেও কাজ না হলে নিজেই বাদী হয়ে পুলিশের কাছে মামলা করে উল্টো হয়রানির মধ্যে ফেলেন ভুক্তভোগীকে। বৃষ্টির এমন হয়রানি ও প্রতারণার শিকার ডজন খানেক মানুষ এখন অনেকটায় হামলা-মামলা ও সম্মানহানীর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। অনেকে ভয়ে প্রতারক বৃষ্টির বিরুদ্ধে তাদের অনেকেই মুখ খুলতেও নারাজ। তবে ভুক্তভোগী অনেকের সাথে প্রতিবেদকের হয়েছে সাক্ষাৎ ও কথোপকথন। মিলেছে বৃষ্টির বিভিন্ন অনৈতিক কর্মের তথ্য-প্রমাণ।

 

 

প্রতিবেদকের কথা হয় প্রথম স্বামী সেলিমের সাথে। তিনি বলেন, প্রায় ১২ বছর সংসার করেছে সে। কিন্তু ঘরে বাচ্চা থাকার পরও সে একাধিক পরকিয়া প্রেমে আসক্ত ছিল। আমি নিজেও হাতেনাতে তাকে ধরেছি। তাই তালাক দিয়েছি। দেনমোহরানা এক লক্ষ টাকা হলেও সে দাবি করেছিল তিন লক্ষ টাকাসহ আমার পৈত্রিক সম্পত্তি। এনিয়ে সে আদালতে মামলা করে। আদালত তাকে এক লক্ষ টাকা দেয়ার আদেশ দেয়। এরপর বাড়ির গরু ও সুদের ওপর ঋণ নিয়ে তার দেনমোহরানার এক লক্ষ টাকা পরিশোধ করি।

 

 

তিনি বলেন, তার কুকর্মের শেষ নেই। আমার সংসারে থাকার পরও সে রনি নামের এক ছেলেকে বিয়ে করে। রনির সাথে সম্পর্ক থাকার পরও সে আবার ফয়সাল নামের আরেক ব্যক্তির সাথেও পরকিয়ায় জড়ায়। রনির কাছে চাপ দিয়ে দেনমোহরানার ৪০ হাজার টাকা ও ফয়সালের কাছে বেশকিছু নগদ অর্থ হাতিয়েছে শুনেছি। তালাকের পর আমার তিন সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে চাইলেও দিতে চায়নি সে (বৃষ্টি)। সন্তানগুলোকে মাদ্রাসায় রেখে একেবারেই বেপরোয়া জীবনে মত্ত বৃষ্টি। মাঝে মধ্যে সন্তানদের নামে আমার কাছে টাকা নেয়। টাকার সমস্যার কথা বললে তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে দিয়ে হুমকি-ধামকিও দেয় সে। তালাক হলেও এখনো সে আমার পিছু ছাড়েনি।

 

 

রনির প্রেমিকা ছিলেন শিরোইল কলোনির ১নং গলির ইমনের মেয়ে দিয়া ইসলাম। দিয়ার সাথে রনির বিয়ের কয়েকদিন আগে বৃষ্টি দিয়ার বাসায় গিয়ে হুমকি দিয়ে আসেন। ওইদিনই রনির সাথে দিয়াকে দেখায় সেখানে ব্যাপক মারধর করেন। ওই অপমান সহ্য না করতে পেরে সকালে দিয়া একটি পারলারে গিয়ে আত্মহত্যা করে। এসব ঘটনায় বোয়ালিয়া থানায় মামলাও হয় বৃষ্টির নামে। কিন্তু কাকতলীয়ভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান বৃষ্টি। রনি ও ফয়সালের পর ২০১৯ সালের দিকে নওদাপাড়া বড় বনগ্রামের শফিকুল ইসলাম শরিফ নামের এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেন বৃষ্টি। বিয়ের পর আড়াই লাখ টাকার আসবাবপত্র কিনিয়ে নেন বৃষ্টি। আসবাবগুলো বিক্রি সময় বাঁধা দিলে শরিফের নামে মামলা করেন শাহমুখদুম থানায়। মামলা তোলার শর্তে জমি লিখে নেন শরিফের কাছে থেকে। শরিফকে বিয়ের পরও অনৈতিকভাবে সম্পর্ক জড়িয়ে পড়েন ছোট বনগ্রামের জৈনক এক ব্যক্তি ও নগরীর চন্ডিপুর এলাকার মাদ্রাসার এক শিক্ষকের সাথে।

 

 

ওই শিক্ষক আরো বলেন, বৃষ্টি তার ছোট ছেলেকে আমার মাদ্রাসায় ভর্তি করে। পরে তাকে একটি ভাড়া বাসা খুঁজে দেয়। পরে বিভিন্ন ভাবে আমাকেও সে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কলেমা পড়ে বিয়ে করে। পরে সন্দেহ হলে তার ব্যাপারে খোঁজ নিলে জানতে পারি- বৃষ্টির সাথে দু’একজন নয়, বরং ডজনখানেক স্বামী রয়েছে। রাজশাহীর বাইরেও কুষ্টিয়ায় ফিরোজ নামের এক চাকরিজীবীকেও ফাঁসিয়েছে বিয়ে ফাঁদে। এমনকি সে মাদকসেবনসহ নানান অনৈতিক কাজে জড়িত। এসব ঘটনা জানার পর আমি তাকে তালাক দেয়। কিন্তু তারপরও সে আমার কাছে থেকে আর্থিকভাবে সুবিধা নেবার জন্য তার সন্ত্রাসী দিয়ে হুমকি দেয়। পরে বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিদের দ্বারা মীমাংসিত হয়। কিন্তু এখনো সে বিভিন্নভাবে আমাকে হুমকি দিয়ে টাকা চায়।

 

 

 

এসব অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে প্রতিবেদকের কথা হয় খোরশেদা আক্তার বৃষ্টির সাথে। তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ সব মিথ্যা।’ বর্তমান স্বামীর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ছিল সিদ্দিক। তার সাথে আমার ডিভোর্স হয়েছে।’ আগে কয়জন স্বামী ছিল এবং বর্তমান স্বামী কে জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিতে ব্যর্থ হন এবং ফোন কেটে দেন।

 

বৃষ্টির প্রতারণা ও বিধি বিরোধী কর্মকান্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. রফিকুল আলম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এমন কোন নারীর ব্যাপারে আমাদের থানায় কোন অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ আসলে অবশ্যই আমরা তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। প্রতারণা, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজির ফাঁদে ফেলে কোন মানুষকে নিঃস্ব করা হলে তা কখনই বরদাস্ত করা হবে না।’

সানশাইন / শামি


প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২৩ | সময়: ১:২০ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine