রমজানে মানবেতর জীবনযাপন রাজশাহীর রেশম শ্রমিকদের

স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী রেশম কারখানার শ্রমিকেরা আট মাস ধরে মজুরি পাচ্ছেন না। মজুরির দাবিতে একাধিকবার কর্মবিরতির ডাক দিয়ে আন্দোলন করেছেন। তবে এখনো বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি।
বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় শ্রমিক আশরাফ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঈদের আগেও কারখানায় কাজের বাড়তি কোনো চাপ নাই। ঈদের জন্য যে বেশি উৎপাদন করব, সে রকম কোনো চিন্তা-ভাবনাই কর্মকর্তাদের নেই।’
আশরাফ আলী বলেন, ‘আট মাস ধরে আমাদের মজুরি আটকে রেখেছে। কিছুদিন আগে আন্দোলন করে বকেয়া মজুরির দাবি জানালাম। বকেয়া টাকা তো পেলামই না, উল্টো আন্দোলনের দিনের হাজিরা কেটে নেওয়া হয়েছে। আমাদের গরিবের টাকা অফিসারদের বউ-বাচ্চাদেরই পেটেই যাক। ওরা পোলাও-বিরিয়ানি খাক। আমরা না খেয়ে থাকি।’
আশরাফ আলীর মতো হতাশায় আছেন আরও ৩৭ শ্রমিক। তাদের কেউই আট মাস ধরে মজুরি পাননি। এসব শ্রমিকদের কেউ দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন। আর কিছু শ্রমিক কাজ করেন চুক্তিতে।
কাপড় বুননের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা প্রতি গজ কাপড়ের জন্য পান ৫০ টাকা। তাদের উৎপাদিত কাপড় বিক্রি করে টাকা জমা করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। কিন্তু শ্রমিকেরা দিনের পর দিন মজুরি পাচ্ছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর শিরোইল এলাকায় অবস্থিত কারখানাটি ২০০২ সালে তৎকালীন সরকার বন্ধ করে দেয়। তখন এই কারখানার ঋণের বোঝা ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। হঠাৎ কারখানার বন্ধ করে দেওয়ায় তখন প্রায় ৩০০ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন।
১৬ বছর পর ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই নতুন করে চালু হয় রেশম কারখানা। নতুন করে আশার আলো দেখতে থাকেন শ্রমিকরা। অনেককে ডেকে এনে নতুন করে কারখানায় কাজ দেওয়া হয়। মজুরি সামান্য হলেও তারা কাজ করছিলেন। তবে আট মাস ধরে মজুরি বন্ধ থাকায় হতাশ হয়ে পড়েছেন শ্রমিকরা।
বকেয়া মজুরির দাবিতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এক সপ্তাহ টানা ধর্মঘট পালন করেছেন শ্রমিকেরা। তখন কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে কাজে যোগ দিলেও এখনো মেলেনি মজুরি।
প্রিন্টিং শাখার কর্মী জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘সামনে ঈদ। আমাদের কোনো পরিকল্পনা নাই। বাচ্চাদের একটা নতুন পোশাক দিতে পারব না। নিজেও কিছু করতে পারব না। দোকানদার আর বাকি দেয় না। এই রোজায় খেয়ে না খেয়ে রোজা করছি। এভাবে কতদিন চলবে?’
কারখানায় নলি বানানোর কাজ করেন শহরের বেলদারপাড়ার মুন্নী বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি নলি বানানোর কাজ করি। প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে পাই। কিন্তু আট মাস ধরে একটি টাকাও দেওয়া হয়নি।’
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মুন্নী বলেন, ‘আমার ২৫ বছরের ছেলে দুই মাস আগে জন্ডিসে মারা গেল। বকেয়া মজুরি থেকে দুই হাজার টাকা ইনচার্জের কাছে চেয়েছিলাম। সেটাও পাইনি। বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মারা গেল।’
শ্রমিকরা কর্তৃপক্ষের গাফিলতির অভিযোগ করে বলেন, কারখানার অফিসারেরা কোনো দায়িত্বই পালন করে না। বড় বড় পদ নিয়ে সবাই বসে আছেন। সরকার কোটি কোটি টাকার মেশিন দিলেও মাত্র কয়েকটি সচল আছে, বাকি সব অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ঈদের সময়ও উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে কর্মকর্তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই।
কারখানা সূত্রে জানা যায়, রেশম কারখানায় ৬২টি লুম মেশিন থাকলেও বর্তমানে সচল আছে মাত্র ৯টি। যা দিয়ে মাসে ৭০০ থেকে ৮০০ মিটার পর্যন্ত কাপড় উৎপাদন হয়।
এ সব বিষয়ে আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ও কারখানার ইনচার্জ কাজী মাসুদ রেজা বলেন, ‘বন্ধ কারখানা ১৬ বছর পর খোলা হয়েছে। কিন্তু এটি এখনও সরকারি প্রজেক্ট বা সিস্টেমে আনা হয়নি। পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। তবে পরিকল্পনায় আনার চেষ্টা চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রেশম বোর্ডের মহাপরিচালক নির্দেশনা দিয়েছেন, ঈদের আগে যেন শ্রমিকদের অন্তত তিন মাসের বকেয়া মজুরি দেওয়া হয়। আমরা তিন মাসের বকেয়া বেতন ঈদের আগেই দিয়ে দেব।’


প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৩ | সময়: ৫:২৩ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ