জীবনযুদ্ধে জয়ী সাবিনার স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প

রায়হান আলম, নওগাঁ: ১২ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর নি:স্ব হয়ে পড়েছিলেন দুই সন্তানের জননী সাবিনা ইয়াসমিন। কিন্তু হাল না ছেড়ে শক্তভাবে হাল ধরেছিলেন বলে আজ তিনি স্বাবলম্বী। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন ও বিভিন্ন রকম সবজি চাষ করে করে তার কর্মঠ জীবনযাত্রা তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বহুদূর। করেছেন ভাগ্য পরিবর্তন।
বলছি নওগাঁর সদর উপজেলার হাপানিয়া ইউনিয়নের আবাদপুর পূর্বপাড়া গ্রামের সাবিনা ইয়াসমিনের কথা। সন্তানদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলাই এখন তার স্বপ্ন।
২০০০ সালে আবুল হানিফার সাথে বিয়ে হয় সাবিনা ইয়াসমিনের। এরপর দুই বছর দেশের বাইরে থাকেন তার স্বামী। সেখান থেকে এসে হাপানিয়া বাজারে স্টিল হাউজে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। ঠিকঠাকভাবেই চলছিল তাদের সংসার। হঠাৎ করে একদিন তার স্বামী সড়ক দুর্ঘনায় আহত হয়। দুর্ঘনার পর রাজশাহীতে চিকিৎসা করান স্বামীর। প্রায় তিস মাস অজ্ঞান হয়ে থাকার পর চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হয়। এরপর আবারও পেটে ব্যাথা দেখা দেয়। অনেক টাকা খরচ করেও কোন সমাধান না হলে আল্ট্রাসনো করান স্বামীর।
আল্ট্রাসনোতে লিভারে পাথর ধরা পরলে জমি বন্ধক রেখে ও ঋণ করে লিভার অপরেশন করান স্বামীর। এতে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু অপরেশনের ১ বছর পর মারা যায় তার স্বামী।
স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসার চালানো নিয়ে খুব দু:চিন্তায় পরেন সাবিনা ইয়াসমিন। মানুষের বাড়িতে কাজ করে চলেছে কোন রকম সংসার। এরপর এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় তার টিকে থাকার সংগ্রাম। শুরু করেন হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন ও বিভিন্ন সবজি চাষ। আস্তে আস্তে ঘুরে দাড়াতে থাকে তার জীবনযুদ্ধের চাকা। করেছেন ভাগ্য পরিবর্তন। তার এই সাফল্য দেখে স্থানীয়রাও এখন খুশি।
ইতিমধ্যে সাবিনা ইয়াসমিন ২০২২ সালে ‘জয়িতা অন্বেষণ’ বাংলাদেশ কার্যাক্রমের আওতায় উপজেলা পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন জয়ীতা সবংর্ধনাও।
সাবিনা ইয়াসমিন তার জীবনের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে বর্তমানে সফল একজন নারী। কিভাবে তিনি স্বাবলম্বী হলেন এবং সব প্রতিকূলতা দূর করে প্রতিষ্ঠা পেলেন এ বিষয়ে কথা হলে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, আমার স্বামী যখন মারা যায় তখন আমার ছেলে ৫ম শ্রেণিতে পড়ত। আর মেয়ের বয়স ৫ মাস। সাথে স্বামীর চিকিৎসা বাবদ রেখে যাওয়া প্রায় ১০ লাখ টাকা ঋণ। স্বামী মারা যাওয়ার পর খুব অভাব-অনটন ছিল সংসারে। কিভাবে সংসার চালাবো ও ছেল-মেয়েদের মানুষ করবো এই নিয়ে খুব চিন্তা হত। কি করবো, না করবো কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। সেই সময় পাশে এসে কেউ দাঁড়ায়নি। বরং অনেকে বলত এত কম বয়সে স্বামী মারা গেছে, হয়তো কোথাও চলে যাবো।
এত টাকা ঋণ কেউ নতুন করে আর টাকা ঋণ বা ধার দিতে চাইতো না। পরবর্তী সময়ে মন থেকে সব হতাশা ঝেড়ে ফেলে ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা জীবনের চরম সত্যটাকে মেনে নিয়ে স্বামীর রেখে যাওয়া একটি সোনার চেন বিক্রি করে দুটি গরু পালন শুরু করি।
৩ মাস পর দুটি গরু থেকে প্রায় ১৬ হাজার টাকা লাভ হয়। পরে আরও তিনটি গরু পালনের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি বিভিন্ন রকম সবজির চাষ। হাঁস-মুরগির ডিম ও সবজি বিক্রি করে সংসার চলতো। এই ভাবেই আস্তে আস্তে সংসারে কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে।
সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, প্রথমে স্বামীর চিকিৎসা বাবদ বাইরে থেকে ঋণ নেওয়া দুই লাখ টাকা পরিশোধ করি। এরপর আস্তে আস্তে আমার স্বামীর তিন বিঘা জমি চিকিৎসার জন্য বন্ধব রাখা হয়েছিল, সেসব জমি ফেরত নিয়েছি। বর্তমানে আরও ৪ বিঘা জমি নিজে বন্ধক নিয়েছে। সংসার চালানো থেকে শুরু করে চেলে-মেয়েদের পড়াশোনাসহ সব-খরচ বাদ বছরে প্রায় দুই লাখ টাকা আয় হয়। বলতে গেলে আমি একা-একাই স্বাবলম্বী হয়েছি। এখন এলাকার মানুষও সহযোগিতা করে।
জীবন যুদ্ধে জয়ী এই নারী বলেন, আমার আশা-ভরসা ও নিঃসঙ্গ জীবনে দুই ছেলে-মেয়েই ছিল সব। নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে এবং কারও কাছে যেন সাহায্যের হাত পাততে না হয়, সে জন্য পরিশ্রম করে এখন এ পর্যায়ে এসেছি।
বর্তমানে ছেলে নওগাঁ সরকারি কলেজে ও মেয়ে ৫শ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভালো কোন সরকারি চাকরি করবে এমনটায় প্রত্যাশা সাবিনা ইয়াসমিনের।
স্থানীয় বাসিন্দা সহিদা নামে এক নারী বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করেছেন সাবিনা। অনেক কষ্ট করে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সবজি চাষ করতেন। এসব করেই স্বামীর বন্ধক রাখা জমি ফেরত নিয়েছে। আবার অন্যার জমিও বন্ধক নিয়েছেন। এখন স্বাবলম্বী হয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ভালোভাবে চলছে তার সংসার।
মতিউর রহমান নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, আমার চাচা মারা যাওয়ার পর চাচি দুইটা ছেলে-মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছে। এরপর তিনি তার পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে আজকে এই জায়গায় এসেছেন। ছেলে-মেয়েদের মানুষের মত করছেন।
এ বিষয়ে নওগাঁ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মির্জা ইমাম উদ্দিন বলেন, সাবিনা ইয়াসমিন জীবনের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে বর্তমানে অদম্য একজন নারী হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে এই সমাজে।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে প্রতিকূলতাকে জয় করে আজ স্বাবলম্বী নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে সাবিনা ইয়াসমিনকে ‘অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী’ ক্যাটাগরিতে উপজেলা পর্যায়ে জয়ীতা সবংর্ধনাও দেওয়া হয়েছে। তার যদি কোন রকম সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন হয় আমাদেরকে জানালে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগিতার চেষ্টা করা হবে।


প্রকাশিত: মার্চ ৯, ২০২৩ | সময়: ৬:০০ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ