২০২৩: করোনার ছোবলে ব্যাহত হবে স্বাস্থ্যসেবা

সানশাইন ডেস্ক: ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ২০২০ সালের শুরু থেকেই এই ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং একই বছরের মার্চ মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনাকে ‘বৈশ্বিক মহামারি’ হিসেবে ঘোষণা করে।
এরপর থেকে বছরের বাকি সময় এবং ২০২১ সালজুড়ে মহামারির দাপট ছিল প্রকট। তবে চলতি বছর করোনা মহামারির যেন কিছুটা উন্নতি হয়। বিশ্বের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ২০২২ সাল কোভিড-১৯ মহামারির সমাপ্তির সূচনা হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে।
মহামারি শুরুর পর থেকে অনেক দেশের পুনরায় উন্মুক্ত হওয়ার বিষয়ে ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর এই পরিবর্তনটি বেশ স্পষ্ট। এছাড়া ২০২১ সালের শেষের দিকে ভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের আগমন, এটিতে লোকদের পুনরায় সংক্রামিত করার ক্ষমতা এবং পরবর্তীকালে কোভিডের সংক্রমণে রেকর্ড বৃদ্ধি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে বিজ্ঞানীরা শঙ্কা জানিয়েছিলেন।
তবুও পরবর্তী মাসগুলোতে ভাইরাসের তুলনামূলক স্থিতিশীল দৃশ্য দেখা গেছে। করোনাভাইরাসের উদীয়মান নানা বৈচিত্র এখন পর্যন্ত আমূল কোনো পরিবর্তন ছাড়াই ওমিক্রনের সাথেই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
এছাড়া করোনার টিকা অনেক লোকের জন্যই এখন গুরুতর রোগের বিরুদ্ধে মূলত প্রধান প্রতিরক্ষা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টকে লক্ষ্য করে টিকার একটি নতুন বুস্টার ডোজও চালু করা হয়েছে। এমনকি যারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তাদের চিকিৎসার উন্নত পদ্ধতিও এখন চিকিৎসা সম্প্রদায়ের কাছে রয়েছে।
বোস্টনের ব্রিগহাম অ্যান্ড উইমেনস হাসপাতালের সংক্রামক রোগের প্রধান ডা. ড্যানিয়েল কুরিটজকেস বলেছেন, এটা অনেকটা এমন যে, ভাইরাসটি কোনোভাবে একটি বিবর্তনীয় উপত্যকায় আটকে গেছে। আর সৌভাগ্যবশত, নাটকীয়ভাবে (ভাইরাসের) ভিন্ন কোনো রূপও আবির্ভূত হয়নি।’
ফলস্বরূপ বিশ্বের অনেক জায়গায়ই মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা উঠে গেছে, স্কুলগুলোতে আবারও শারীরিক উপস্থিতিতে ক্লাস শুরু করেছে, ছুটিতে ভ্রমণে বের হওয়া এবং বড় উদযাপনগুলোতে অংশ নেওয়া আবারও সম্ভব হয়ে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত সেপ্টেম্বরে আমেরিকানদের পরিবর্তনশীল আচরণের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘মহামারি শেষ হয়ে গেছে।’
বৈশ্বিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা অবশ্য এতোদিন ধরে মেনে চলা সচেতনতা দূরে ঠেলে দেওয়ার বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সতর্ক করে দিয়েছেন। অন্যদিকে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে জারি করা কোভিড জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থার সমাপ্তি এখনও ঘোষণা করেনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
আর তাই সেপ্টেম্বরে বাইডেনের সেই মন্তব্যের পরপরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এখনও সেখানে নেই। তবে শেষ দেখা যাচ্ছে।’ কোভিডের সবচেয়ে তীব্র হুমকি অনেক জায়গায় কমে গেলেও এটি এখন দৈনন্দিন জীবনে বড় আকার ধারণ করছে। মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এছাড়া বিশ্বব্যাপী দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা এখনও প্রায় ২ হাজারের কাছাকাছি রয়েছে।
করোনার নতুন সংক্রমণ নিয়ে মানুষের মনোযোগ বর্তমানে অনেকটা সাইডলাইনে রয়েছে এবং এটিকে পাশ কাটিয়েই মানুষ কর্মস্থলে এবং শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাচ্ছে। এছাড়া দীর্ঘ কোভিডের ঝুঁকি পুনরায় সংক্রমণের সাথে বাড়তে দেখা যাচ্ছে। ভ্যাকসিন, বুস্টার শট এবং চিকিৎসার সুযোগ এখনও বিশ্বব্যাপী রয়ে গেছে অসম।
অন্যদিকে চীনের জিরো কোভিড পলিসি দেশটিকে এতোদিন করোনা সংক্রান্ত মৃত্যুকে ন্যূনতম অবস্থায় রেখেছে এবং সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি হলেও চীনা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ভেঙে পড়া থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু কঠোর সেই কোভিড নীতির কারণে হয়তো চীনের ১৪০ কোটি জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভাইরাসের সংস্পর্শে নাও এসে থাকতে পারে। যার ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের শরীরে প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কারণ টিকা দেওয়ার উচ্চ হারের পাশাপাশি প্রাকৃতিক এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা তৈরি করে থাকে।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ২০২৩ সাল বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর করোনা মহামারির সম্পূর্ণ প্রভাবকে বেশ জোরালোভাবে নিয়ে আসবে। পরিসংখ্যান বলছে, করোনাভাইরাস মহামারি শৈশবকালীন টিকাদান থেকে শুরু করে ক্যানসার স্ক্রিনিং পর্যন্ত সকল ধরনের স্বাস্থ্যসেবাকে ব্যাহত করেছে। কিছু দেশে মানুষের আয়ু কমে গেছে, অন্যদিকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ আকাশচুম্বী হয়েছে। এছাড়া দীর্ঘ কোভিডের প্রভাবগুলো এখন কেবলমাত্র স্বীকৃতি পাচ্ছে এবং জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় এমন সব ফাঁক বা দুর্বলতা বেরিয়ে এসেছে যা আগে কখনও দেখা যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন প্রশ্ন হচ্ছে- বিশ্বজুড়ে এই পরিবর্তনগুলো অব্যাহত থাকবে কিনা এবং যদি থাকে তাহলে প্রতিক্রিয়া হিসাবে কী ধরনের নীতি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং এর সদস্য দেশগুলো ভবিষ্যতের যেকোনো প্রাদুর্ভাব আরও ভালো ভাবে সামলানোর জন্য একটি মহামারি চুক্তি তৈরি করছে।
করোনাভাইরাস নিয়ে এমন লোকদের জন্য সতর্কতার প্রয়োজন থাকবে যাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হয় এবং আরও বিস্তৃতভাবে যখন কোনো নির্দিষ্ট স্থানে ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়বে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে জনাকীর্ণ জায়গায় লোকদের মাস্ক আবারও পরিধান করার কথা বিবেচনা করা উচিত এবং কখন কোন টিকা দেওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে আপ টু ডেট থাকা উচিত।
এছাড়া সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিষয়ে সতর্ক রয়েছেন। কারণ ভাইরাসের নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট হয়তো নাটকীয়ভাবে ভ্যাকসিন এবং করোনার বিদ্যমান চিকিৎসা পদ্ধতিকে দুর্বল করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস গত সপ্তাহে বলেছেন, করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা এবং টিকাদানের হারের ব্যবধান ‘ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভবের জন্য নিখুঁত পরিস্থিতি তৈরি করে চলেছে যা উল্লেখযোগ্য মৃত্যুর কারণ হতে পারে।’


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২২ | সময়: ৫:১৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ