বরেন্দ্রের কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন

স্টাফ রিপোর্টার : সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলেও কৃষি। দিন যত এগুচ্ছে ঠিক ততই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে কৃষিতে। সনাতনী কৃষি পদ্ধতির দিন শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এখন শুরু হয়েছে আধুনিক কৃষি পদ্ধতির প্রয়োগ। প্রযুক্তির কল্যাণে এক জমিতে ফলছে হরেক রকম ফল ও ফসল। সব ক্ষেত্রেই সফল হচ্ছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। এক সময় এ অঞ্চলে ধান পাট আর পান ছিলো প্রধান অর্থকারী ফসল। তবে এখন সেই ধারা পরিবর্তন করে একই জমিতে কৃৃষকরা বারো মাস ফলাচ্ছেন সব ধরণের পন্য। কেবলমাত্র সচেতনতা ও উদ্ভাবনী ইচ্ছে শক্তি দিয়েই অসম্ভবকে সম্ভবে করেতে পারছেন প্রত্যন্ত গ্রামের তৃণমূল কৃষকও।
‘সাথী ফসল’ চাষ পদ্ধতি তেমনই এক সফল কৃষি গাঁথা। এক জমিতে দুই বা তার অধিক ফসল এখন রঙিন স্বপ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে কৃষককের প্রযুক্তির ছোয়ায়। সেই স্বপ্ন দোলা দিচ্ছে কৃষকের মনে। এক জমিতে কম খরচে ও কম সময়ে অধিক মুনাফা হওয়ায় নতুন সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে ‘সাথী ফসল’।
বর্তমানে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিতে একই জমিতে একই সময় দুই বা অধিক ফসল উৎপাদনে আগ্রহ বেড়েছে প্রান্তিক কৃষকদের। যে কোনো একটি ফসলের সঙ্গে চাষ করা হচ্ছে সময়োপযোগী আরেকটি ফসল। যেমন আমের বাগানে চাষ হচ্ছে ধান সেই ধানের সঙ্গে ফলছে আরও সাথী ফসল। বিশেষ করে ড্রাগন চাষ এখন হচ্ছে সাথি ফসল হিসেবে।
বাজারে ড্রাগন ফলের চাহিদা এখন তুঙ্গে। তাই ড্রাগন ফল বিক্রি করে আর্থিকভাবে অধিক মুনাফা পাচ্ছেন কৃষক। অন্যদিকে শীতকালীন আগাম সবজি হিসেবে বাজারে বিক্রি করতে সাথী ফসল হিসেবে বাঁধাকপিও চাষ করছেন অনেক কৃষক। এতে এক সঙ্গে ফল ও ফসলে বাড়তি অর্থে উপার্জন হচ্ছে চাষিদের। এরফলে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যুক্ত হচ্ছে স্থানীয় এ কৃষিপণ্য।
কম সময়ে যে কোন ফসলের জন্য নতুন চাষ পদ্ধতির জুড়ি নেই। রাজশাহীর কৃষকদের মধ্যে তাই ফল ও ফসল উৎপাদনে চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা অনুপাতে খাদ্যপণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছেই। কৃষকরাও এখন প্রতিযোগীতামুখি হয়েছেন।
তাই এই সাথী ফসল পদ্ধতিতে সবাই বিভিন্ন ফল ও ফসল চাষ করো দেশের কৃষিখাতে বিপ্লব ঘটাচ্ছেন কৃসক। আধুনিক কৃষি সফলতার নতুন মাইল ফলক এখন রাজশাহীর কৃষি। সব ধরনের সবজি চাষও বার মাস হচ্ছে এখন এ অঞ্চলে। উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে একই জমিতে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে অধিক ফসল উৎপাদনে কৃষকদের নানা পরামর্শ দিতে তাই মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে কৃষি অধিদফতরও।
কৃষি বিভাগের নির্দেশনায় জমিতে মৌসুম ভিত্তিক দুইটি ফসল সঠিকভাবে চাষাবাদ এবং পরিচর্যা করে আর্থিক সচ্ছলতা পাচ্ছেন দেশের শস্য ভাণ্ডার খ্যাত রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকরা। এতে করে দিন দিন কৃষকদের মধ্যে দুই ফসলি চাষাবাদ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে।
রাজশাহীর পবা উপজেলায় ধান, শাক-সবজি ও ড্রাগনসহ মৌসুমি ফল চাষে দেখা দিয়েছে অপার সম্ভাবনা। বিগত বছরগুলোতে রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলা কৃষকরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিভিন্ন সবজি চাষাবাদ করে আসছেন। এসব চাষাবাদের মধ্যে ড্রাগন ছাড়াও শীতকালীন টমেটো, আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, লাউ, বেগুন, ঝিঙা, করলা ও বিভিন্ন ধরনের শাক ও ফসল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও কৃষি বিভাগের পরামর্শে ড্রাগনের সঙ্গে একই জমিতে নিয়ম অনুযায়ী বাঁধাকপি, লাউ, ঝিঙ্গা, পটল, বেগুন চাষ করে সফলতা মিলেছে।
রাজশাহীর পবা উপজেলার বারনই নদীর তীরবর্তী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার প্রায় জমিতেই ড্রাগন চাষের পাশাপাশি শাক-সবজি চাষের কৌশল অবলম্বন করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। প্রথমে একজন করছেন। এরপর তার সফলতা দেখে অন্যজন আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এভাবে চক্রাকারে বাড়ছে দুই ফসলি আবাদ। শুধু পবা নয় রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, বাগমারা, পুঠিয়া উপজেলাতেও এখন চাষাবাদ হচ্ছে সাথি ফসল হিসেবে হরেক ফসল।
পবা উপজেলার বারনই নদীর তীরে থাকা পূর্ব পুঠিয়াপাড়া গ্রামের এমনই এক সফল কৃষকের নাম মোফাক্কার হোসেন। তিনি একজন মাদরাসার শিক্ষক হয়েও আদি পেশা কৃষি ছাড়েননি। নিজ গ্রামেই থাকা মোট তিন বিঘা জমিতে একইসঙ্গে ড্রাগন এবং বাঁধাকপি চাষ করেছেন।
তার জমিতে গিয়ে দেখা যায় আধুনিক এ চাষবাদ পদ্ধতি। সিমেন্টের রিংয়ের ওপর ড্রাগন ফল এবং নিচের মাটিতে চাষ করছেন শীতকালীন বাঁধাকপি। এটি চাষ পদ্ধতি খুবই ফলপ্রসূ বলে জানালেন মোফাক্কার হোসেন। এ পদ্ধতিতে তিনি অল্প সময়ে ছোট্ট ড্রাগন বাগান এবং শীতকালীন সবজির ক্ষেত প্রতিষ্ঠা করেছেন। এরই মধ্য ফল দিতে শুরু করেছে ড্রাগন গাছ।
শিক্ষক মোফাক্কার হোসেনের ড্রাগন বাগান ঘুরে দেখা গেছে নানা গুণ সমৃদ্ধ ড্রাগন ফলের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। পাশাপাশি অন্য সবজি চাষেও তিনি পেয়েছেন সফলতা। তার ড্রাগন বাগানের ফাঁকা জমিতে এখন বাঁধাকপির চাষ শুরু করেছেন। এর আগে সেখানে বেগুন ও আলু চাষ করেছিলেন বলে জানান তিনি। রোগ-বালাই কম হওয়া, চাষ পদ্ধতি সহজ হওয়া এবং বাজারে ভালো চাহিদা থাকায় ভিনদেশী এ ফল চাষে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন আশপাশের কৃষকরাও।
বর্তমানে তার তিন বিঘা জমিতে ৪৬০টি সিমেন্টের চিকন পিলার ও রিংয়ের ওপর প্রায় ২ হাজার ড্রাগন গাছ লাগানো রয়েছে। পাশাপাশি নিচের জমিতে বাঁধাকপি চাষ করছেন। ড্রাগনের মাচার নিচে একসঙ্গে শীতের আগাম বাঁধাকপি রোপণ করা হয়েছে। তার দেখাদেখি অন্য কৃষকরাও তাদের বাগানে থাকা চালকুমড়া, ঝিঙা, লাউ, পটল ও শসার জন্য তৈরি করা মাচার নিচে ‘সাথী ফসল’ হিসেবে কাঁচা মরিচ ও আদাসহ অন্যান্য সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
কৃষক মোফাক্কার হোসেন জানান, তিনি ২০১৮ সালে তিন বিঘা জমিতে ড্রাগনের কাটিং রোপণ করেন। কাটিং রোপণের পর থেকে আড়াই বছর সময় লাগে ফল পেতে। জমিতে বেড তৈরি করে ড্রাগন চারা রোপণ করতে হয়। বেড তৈরি থেকে শুরু করে চারা রোপণ ও গাছের পরিচর্যায় এ পর্যন্ত তার প্রায় ৫ লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। এ ক্ষেত সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে প্রায় দুই যুগ টিকবে এবং ফল দেবে। আর এখানে সার প্রয়োগ, সেচ খরচ ও শ্রমিক খরচ বাদে প্রতি মৌসুমে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা আয় হবে।
বর্তমানে তার বাগানে লাল ও সাদা দুই প্রকারে ড্রাগন ফল রয়েছে। প্রতিটা গাছে ড্রাগন ফল ধরেছে। পর্যায়ক্রমে ফলন আরও বাড়বে। এরই মধ্যে তার বাগানের ড্রাগন ফল বাজারজাত করা শুরু করেছেন। বাজারে এখন মৌসুমী ফলে ভরপুর থাকায় প্রতি কেজি ড্রাগন পাইকারি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ড্রাগন চাষের প্রথমে পরিচর্যাজনিত সমস্যার কারণে ২০২০ সালে অল্প পরিসরে ফল পেলেও এবার গোটা ড্রাগনের বাগান জুড়ে মন জুড়ানো ফুল এসেছে। ফুল ফোটার ৩০ দিনের মাথায় ড্রাগন ফল তোলার উপযুক্ত হয়। ড্রাগন চাষে কীটনাশক ব্যবহার করা প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয় ফলকে নিরাপদ রাখার জন্য। ১৫ থেকে ২০ দিন পর পর ৮ থেকে ১০ মণ ড্রাগন ফল সংগ্রহ করে রাজশাহীর বাজারেই বিক্রি করেন তিনি।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ডিডি) মোজদার হোসেন বলেন, পবার কৃষক মোফাক্কার হোসেন সাথী ফসলে সফল হয়েছেন। তিনি একই জমিতে এক খরচে দুই-তিন জাতের ফসল উৎপাদন করার জন্য এখন ওই এলাকার বেকার যুবকদের কাছে উদাহরণ এবং অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছেন। মোফাক্কার এ নতুন চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে স্থানীয়ভাবে তরুণ চাষিদের মনে শক্তি যুগিয়েছেন। তার দেখাদেখি এখন অন্যরাও সাথী ফসল চাষ শুরু করেছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ডিডি মোজদার হোসেন আরও বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর প্রযুক্তি ও পরামর্শ দিয়ে পুরো বিষয়টি দেখভাল করছেন। তাদের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারাও মাঠ পর্যায়ে গিয়ে ফসলের রোগবালাইসহ দমনসহ বিভিন্ন সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান দিচ্ছেন। তাই ‘সাথী ফসলে’ মানুষের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং কৃষকদের মনে নতুন স্বপ্ন জাগিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন এই কৃষি কর্মকর্তা।


প্রকাশিত: অক্টোবর ৩১, ২০২২ | সময়: ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ