সর্বশেষ সংবাদ :

আবাসন ব্যবসায় অশনি সংকেত, ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার শঙ্কায় লক্ষাধিক মানুষ

শাহ্জাদা মিলন

প্রতিদিনই আবাসন খাতের জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে টাকায়। কমছে পয়সায়। ফলে রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে আবাসন খাতের উপর অশনি সংকেত নেমে আসছে। একটি বহুতল বাড়ি বানাতে অন্তত তিনবছর সময় লাগে। সেক্ষেত্রে তিনবছর আগের দামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাড়ি বানানো ও ক্রেতাদের নিকট ফ্লাট হস্তান্তর করতে যে দাম ধরা হয়েছিলো তার প্রায় দ্বিগুনের মতো দাম বেড়ে যাওয়ায় এ শিল্প এখন বিপদের সম্মুখীন। আবাসন ব্যাবসায়ীদের সংগঠন ( রেডার) নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বললে তারা হতাশা ও টিকে থাকার জন্য বর্তমান অবস্থায় সরকারী ভর্তুকির বিষয়টি তুলে এনেছেন।

 

 

 

নেতৃবৃন্দ দাবি করেন, রড ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পাওয়া যেত কেজিতে ৭৬.৫০ পয়সা, বর্তমানে ৯৬.৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। শতকরা দাম বেড়েছে ২০ %। সিমেন্ট ২০২১ সালের শেষে দাম ছিলো বস্তায় ৪২৫ টাকা ,বর্তমানে ২২ থেকে ২৫% বেড়ে হয়েছে ৫৩০ থেকে ৬৫০ টাকা বস্তা। ডোমার বালু ( ঢালাই) গত বছর শেষ সময়ে ছিলো ৩৮ টাকা সিএফটি বর্তমান দাম ১৯% বেড়ে ৪৭ টাকা সিএফটি। লোকাল বালু ( ভরাট) ২০২১ সালে ডিসেম্বরে পাওয়া যেতো ৩১০০ টাকায় এক ট্রাক। বর্তমানে ২২% বেড়ে ৪০০০ টাকায় মিলছে এক ট্রাক। ইট ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খরচসহ মিলতো ৯ হাজার টাকায়। বর্তমান দাম প্রায় ১২ হাজার টাকা। এটি ছিলো চলতি বছর ২০২২ সালের প্রথম ৮ মাসে আবাসন খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট জরুরী জিনিসপত্রের দাম বাড়ার তালিকা।

 

 

 

 

নওদাপাড়ায় আবাসিক এলাকায় রাজমিস্ত্রি সেন্টু গফুর,নূর আলম,হাসিবুল,আলামিন রড ও রাজ মিস্ত্রির কাজ করছেন। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মিস্ত্রিদের খরচ নেয়া হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা এবছরের এক দিনের শ্রমের মূল্য। লেবার খরচ শ্রমিকের মান অনুযায়ী ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা। মিস্ত্রিরা জানান, দ্রব্যমূল্যের দাম যদি এভাবে বাড়তে থাকে তবে আগামী বছর এ টাকায় কাজ করা সম্ভব হবে না।

 

 

 

 

রাজশাহীর নওদাপাড়া ছায়ানীড় এলাকায় বাড়ি করছেন তৈয়ব আলী। এবছরের শুরুতেই তিনি বাড়ির কাজে হাত দেন। গতবছর যে হিসাব করে বাড়ির কাজে হাত দেন তাতে ছয় ইউনিটের তিনতলা বাড়ি ছাদ ঢালাইসহ অন্যান্য যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তিনি জানান,দ্বিতীয় তলার ছাদ করা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ তৃতীয় তলা পর্যন্ত করতে যে টাকা লাগতো তা দ্বিতীয় তলা করতেই শেষ। তিনি বলেন,প্রতিদিন দাম বাড়ছে। ভালো সিমেন্ট ৬০০ টাকার বেশি। লেবার খরচ বেশি। রডের দাম কেজিতে ১৫ টাকার বেশি লাগছে গতবছরের হিসাবে। লিফটের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। এভাবে দাম বাড়লে সামনে শতকরা ১০ জন বাড়ি বানাতে পারবে কিনা সন্দেহ করছি।

 

 

মহানগরীর কয়েরদাড়া বিলপাড়ায় সিহাব ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্ক শপের মালিক জানান, রাজশাহী অঞ্চলজুলে অন্তত বিভিন্ন ধরনের ১৫০০ কারখানা রয়েছে। তার কারখানায় গতবছর হেড মিস্ত্রির বেতন ছিলো ৫৫০ টাকা। বর্তমানে ৬৫০ টাকা দিতে হ”েছ। সাধারন শ্রমিকরা পান ৪৫০ টাকার জায়গায় ৫৫০। ফলে ১০০ টাকা করে গড়ে বেড়েছে। এছাড়া ওয়েল্ডিং স্টিক দাম বেড়েছে ১০০ টাকা করে। তিনি জানান,প্রায় ১৮ বছর ধরে ব্যবসা করছেন তবে গত নয় মাসের মতো এভাবে দাম বাড়েনি আবাসন ব্যবসার নির্মাণ সামগ্রীর।

 

 

এদিকে প্রথম সারির আবাসন প্রতিষ্ঠান আল-আকসা প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রেডা’র সাধারন সম্পাদক মিজানুর রহমান কাজী বলেন, রাজশাহীতে আবাসন ব্যবসা মূলত ২০১২ সাল থেকে শুরু হয়। এর আগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু কাজ হয়ে থাকতে পারে। এর দুই বছর পর থেকে গতবছরের শেষ পর্যন্ত ভালো অবস্থানে এসেছিলো রাজশাহীর আবাসনখাত। বহুতল ভবন তৈরিতে রেডা বড় ভূমিকা পালন করে আসছিলো।

 

 

 

 

এখানে আমরা মানুষের সামর্থের মধ্যেই খুব অল্প লাভে আবাসনের ব্যবস্থা করেছিলাম। এই একটা সেক্টরে প্রায় তিন লক্ষ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত। গত আট মাস থেকে আবাসন খাতের জিনিস পত্রের দাম বাড়ার কারনে অনেকেই কাজ থামিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আমরা চরম বিপদের মধ্যেও ক্রেতাদের আস্থা বজায় রাখতে ও নিজ প্রতিষ্ঠানের সুনাম ধরে রাখতে লস করে হলেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে মনে হয়েছে,যদি এপর্যায়ে এসে থেমে যাই তবে এ খাতে বিশাল শূণ্যতা সৃষ্টি হবে যা হয়তো আমাদের সমাজকে বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

 

 

মিজানুর রহমান আরো জানান, যদিও অনেক প্রজেক্ট আমরা ক্রেতাদের কাছে আগে বিক্রি করে থাকি সেক্ষেত্রে বর্তমানে একটি ভবন তৈরি করতে যে উৎপাদন খরচ হচ্ছে তাতে ইতোমধ্যে ৩০% থেকে ৪০% লসে আছি। তারপরেও এটি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমরা ধরে রেখেছি। আবাসন খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট কাউকে করোনার মধ্যে লাইনে দাড়াতে দিইনি,একটি মানুষের চাকরি হারা হতে দিইনি সেই জায়গা থেকেই আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে কতোদিন পারবো সেই শঙ্কায় আছি।

 

 

 

 

দ্রব্যমূল্যের লাগাম অবশ্যই টেনে ধরার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন,বর্হিবিশ্বে যে সমস্যা সেটি আমরা জানি। আমদানি পণ্যের দাম বাড়তে পারে কিš‘ দেশে উৎপাদিত পণ্য ঝাড়ু, ইট, বালুসহ আরো কিছু নির্মাণ সামগ্রীর দাম কেন দাম বাড়ছে সেদিকে সরকারী সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ দাবি করেন। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধকে করে অনেক ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের জন্য সারাদেশের মানুষের সাথে জুলুম করছে এদিকে সরকারের নজরদারী আরো বাড়ানোর কথা জানান তিনি। একটা পণ্য আমদানি করতে গিয়ে যদি ২০ টাকা খরচ বাড়ে সেটি যেনো দেশে ৪০ টাকা না বাড়ে সেটি অবশ্যই মনিটরিং করা দরকার।

 

 

রেডার সাধারন সম্পাদক আরো জানান, রাজশাহীতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় ব্যবসা হচ্ছে আবাসন ব্যবসা। আমরা আবাসন ব্যবসায়ীরা কিভাবে আছি কেউ খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না। সরকারের প্রতি বিশেষ অনুরোধ আমাদের পাশে দাড়ানো কিংবা আমাদের সাহস দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

 

 

 

রেডার বর্তমান সভাপতি ও মেসার্স রহমান ডেভেলপারর্স এর ম্যানেজিং পার্টনার তৌফিকুর রহমান লাভলু আবাসন ব্যবসার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলেন, দাম বাড়ায় খুব অস্বস্তিতে আছি। বেহিসেবিভাবে যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে সেটি আবাসন খাতের জন্য খারাপ অবস্থা বলা যায়। গত নয় মাসের ব্যবধানে যে হারে দাম বেড়েছে তাতে লসটাকে আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে। দ্রুত যতি সরকার কৃষির মতো প্রণোদনা না দেয় তবে অনেক ছোট ছোট ব্যবসায়া হারিয়ে যাবে। আর বড় ব্যবসায়ীরা লস টানতে না পেরে ব্যবসা বন্ধ রাখতে বাধ্য হবেন। দ্রুতই আমরা বোর্ড মিটিং করবো সদস্যদের নিয়ে। বর্তমানে অনেক ব্যবসায়ী তেলের দাম খাদ্যজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে আবাসন খাতের পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন এটা অনৈতিক।

 

 

তৌফিকুর রহমান আরো জানান,যদি দাম বাড়া অব্যাহত থাকে তবে নিরুপায় হয়ে কাজ যদি বন্ধ করা হয় তবে অন্তত আড়াই থেকে তিন লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে বিপদে পড়বে। যেটি আমাদের কাম্য নয়। এই সেক্টরকে বাঁচাতে কঠোর মনিটরিংয়ের দাবি জানান তিনি।

সানশাইন / শামি


প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২২ | সময়: ১০:০২ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine