সর্বশেষ সংবাদ :

‘আলপনা গ্রাম’ যেন শিল্পীর পটে আঁকা ছবি!

সিরাজুচ ছালেকীন

‘আলপনা গ্রাম’ কথাটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে নান রঙের ছবি। ছনের চাল, মাটির দেয়াল, খরের পালা, একপাল গরু এমন চিত্রই বুঝি সেই গ্রামের। মনে হবে গ্রামটি বুঝি কোনো শিল্পীর পটে আঁকা ছবি। কিংবা ঘরগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর থরেথারে সাজানো। যেখানে ছোট ছেলে-মেয়ে দল বেধে খেলা করছে। নববধূ কলসি নিয়ে জল আনছে। রাখাল গরুর পাল নিয়ে মাঠে যাচ্ছে। কিন্তু আলপনা গ্রামে গেলে হয়তো এমন চিত্র দেখা যাবে না।‘ মাটির ঘরগুলো দেখলে যে কেউ শিল্পীর পটে আঁকা ছবির সাথে তুলনা করতে ভুলবেন না। কিংবা গ্রামের সৌন্দর্যের পটভূমি দেয়ালের আলপনার সাথে গুলিয়ে ফেলবেন। লোকমুখে প্রচলিত এমনই এক গ্রাম ‘আলপনা গ্রাম’।

 

যে আলপনা গ্রাম আজ লোকমুখে প্রচলিত। আসলে খাতা কলমে সেই গ্রামের নাম টিকোইল। এই গ্রামটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলায়। প্রথমে ওই গ্রামের একটি মাটির বাড়িতে আলপনা করা ছিলো। সেই বাড়ির নাম ছিলো আলপনা বাড়ি। কিন্তু মেঠোপথ আর মাটির বাড়ির দৃষ্টিনন্দন আলপনা গ্রামের নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। এলাকার লোকজনও এই নামেই পরিচিত। দেয়ালে বাহারী রঙের ফুল, পাখি, লতাপাতা আর হরেক রকমের চিত্র নজর কেড়ে নিবে সবার। দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন জায়গা থেকেও ঘুরতে আসেন এই আলপনা গ্রামে।

 

তবে বাড়ির উঠানে আলপনা আঁকা থেকে আলপনা গ্রাম হয়ে উঠার গল্প একটু আলাদা। এর পিছনে রয়েছেন ওই গ্রামের বাসিন্দা দেখন বর্মণ। তিনি বাসুদেব বর্মণের স্ত্রী। তিন মেয়ে নিয়ে ছিলো তাঁর সংসার। তবে তিন মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট বয়স থেকেই আলপনা করার শখ ছিলো দেখনের। হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা-পার্বণ ও বিয়ের অনুষ্ঠানে এখনো আলপনা করা হয়। সেই সূত্রে নিজের মতো করে বিভিন্ন মাটি আর চালের গুড়া দিয়ে রং বানিয়ে উঠান আর মাটির ঘরের দেয়ালে আলপনা করতেন তিনি। অল্প বয়সে বিয়ে হলেও শখ ছাড়তে পারেননি। তাই সময় পেলেই আলপনা করতেন। তাঁর দেখাদেখি গ্রামের অনেক নারীও তাদের মাটির দেয়ালে আলপনা করছে। কিন্তু এখন দেখনের বয়স প্রায় ৫৪ বছর ছুঁইছুঁই। চোখের যতিও কমে এসেছে। আগে যে আলপনা করতে পারতেন নিমিষে তা এখন সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও সময় পেলে আলপনা করতে বসে যান বাড়ির উঠানে কিংবা দেয়ালে।

 

তবে প্রথমদিকে আলপনা করা এতোটা সহজ ছিলো না। কেননা ওই সময়ে বিভিন্ন কোম্পনীর রঙ স্থানীয় বাজারে পাওয়া যেতো না। আর পাওয়া গেলেও শখের আলপনা করার জন্য সাধ্য ছিলো না। শখের তাগিদে এঁটেল মাটির সঙ্গে প্রাকৃতিক নানা জিনিস মিশিয়ে তৈরি করে নিতেন প্রয়োজনীয় রঙ। খড়িমাটি ভিজিয়ে ‘আখির’ বের করে তা থেকে লাল রং আর আতপ চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয় সাদা রঙ। এ ছাড়া মাটি পানিতে ভিজিয়ে রাখলে পানির ওপরে সাদা স্তর পড়ে। এই স্তর দিয়েই তৈরি করা হতো সাদা রঙ। শুকনো বরই, চূর্ণের আঠা, আমের আঁটির শাঁসচূর্ণ, গিরিমাটি, মানকচু ও কলাগাছের আঠার সঙ্গে রঙের মিশ্রণ কয়েকদিন ভিজিয়ে রেখে আলপনা আঁকার রং তৈরি করতেন তিনি।

 

গল্পের মতো মনে হলেও উঠান কিংবা দেয়ালের আলপনা ঠিক রাখা খুব কষ্টের। মাটির দেয়ালে অল্প বৃষ্টি বা জলের ছোঁয়া পড়লেই রঙ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। নতুন করে আবার আলপনা করতে হয়। বৃষ্টি আসলেই পুরো উঠান আর দেয়াল মুড়ে দিতে হয় পলিথিন দিয়ে। এখন গ্রামটির হিন্দু মুসলিম সব পরিবারেই এই আলপনার শোভা দেখা যায়। আলপনা যেন গ্রামের একটা উৎসবে পরিণত হয়েছে। গ্রামের ছোট থেকে বুড়ো সবাই মেতে উঠে রঙের উৎসবে।

 

শখের বসে করা আলপনা এখন দেশজুড়ে সমাদৃত। শখের বসে করা আলপনা একদিন সবার মন ছুঁয়ে যাবে এটা কল্পনাও করেননি দেখন বর্মণ। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক আসায় খাওয়া দাওয়ার সময় ঠিক থাকে না। সামান্য হাতের কাজ দেখার জন্য সবাইকে ফিরিয়ে দিবে ভেবে কখনো কাউকে না করতে পারেন না। অনেকে টিকিট করার কথা জানালেও তিনি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘সম্মানের চেয়ে টাকা বড় নয়। লোকজন আমাকে এই কাজের জন্য সম্মান করে। আমি এই সম্মানটুকু পুঁজি করে ব্যবসা করতে পারবো না। অনেকে ভালবেসে আলপনা করার জন্য টাকা দেয় তা দিয়ে রঙ কিনে আনি। তবু নিজের প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করি না। আর আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততোদিন টিকিট করবো না। মেয়েদেরও বলে দিয়েছি যাতে ওরাও এই টিকিট না করে।’

 

বরেন্দ্র অঞ্চল এমনিই আম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত, তার সাথে আছে পুরানো সব স্থাপনা। এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে আলপনা গ্রাম। দিন দিন এই গ্রাম দেখতেও ভিড় জমাচ্ছেন দেশ বিদেশের ভ্রমণ প্রিয় লোকজন। খাতা কলমে না থাকলেও এই গ্রাম জায়গা করে নিয়েছে সবার অন্তরে। ইট পাথরের এই কংক্রিটের শহরে এমন নিবিড় স্নিগ্ধ গ্রাম আর কোথায়?

 

সানশাইন / শামি


প্রকাশিত: এপ্রিল ২৩, ২০২২ | সময়: ১:১১ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine