লিটনের উন্নয়ন দিয়ে জিতলো সরকার সমর্থক

আব্দুুল্লাহ আল মারুফ

ঘড়ির কাঁটায় ৪টা ১৫, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা বাসটি গোদাগাড়ী পৌছালো। গন্তব্য রাজশাহী। দ্রুত বাসে উঠলাম। বাসের প্রতিটি আসনেই যাত্রী, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসতে হলো একেবারে পেছনের আসনে।

 

৪টা ২৩ মিনিট। বাস ছাড়লো। সবকিছুই ঠিক ঠাক। সারাদিন পরিশ্রমের কারনে বাসে ওঠার সাথে সাথে প্রায়শই তন্দ্রা গ্রাস করে আমাকে। আজও ব্যতিক্রম হলোনা। হঠাৎই ঘুম ভাঙ্গলো টিকিট চেকারের ডাকে। কোন মত তাকে ভাড়াটা দিয়েই আবার ঘুমাতে চাইলাম, কিন্তু পাশের কিছু যাত্রীর উচ্চস্বরের কথোপকথনে তা আর সম্ভব হলোনা! সেদিকেই মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলাম। বুঝলাম, সরকারকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলছে। বিষয় আমারিকার দেওয়া নিষেধাজ্ঞা। মনে মনে বললাম, আদার ব্যাপারীর জাহাজের খোঁজ! অনেকটা বিরক্তি নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, রাজশাহী আরো ১৯ কিলোমিটার দূরে! তাদের উচ্চস্বরের এই টকশোতে যে আর ঘুম হবেনা, সেটা মেনে নিয়েই এবার চেষ্টা করলাম তাদের টকশোটাকে উপভোগ করার।

 

তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, তারা একে অপরের পরিচিত ৪ জন আছেন এবং সকলেই বেশ উচ্চশিক্ষিত। একজন সরকারের পক্ষে কথা বলছেন, দু’জন সরকারের বিপক্ষে কথা বলছেন, যাদের একজনকে কট্টোর সরকার বিরোধী মনে হলো। চতুর্থজনের কথা শুনে মনে হলো, কোন দলকে পছন্দ না করলেও ১৫ আগস্টের প্রতি তার একটা দুর্বলতা আছে।

 

তাদের তুমুল আলোচনা সমালোচনার মধ্যেই বাস ছুটে চলেছে তার নিজস্ব গন্তব্যে। সরকারের সমালোচকরা নির্বাচন, খুন, গুম, সমসাময়িক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সবকিছুকে অস্ত্র করে ধরাশায়ী করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন সরকার সমর্থককে। সরকার সমর্থকও মাগুরা নির্বাচন, টানা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, পেট্রোল বোমা, ২১ আগস্টকে অস্ত্র করে কুপোকাত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার বিরোধীদের। তবে কেউ কাউকে হারাতে পারছেননা, কারন সবার মানসিকতাতেই পরিস্কার হয়ে উঠছিলো, ‘বিচার মানি, তবে তালগাছটা আমার’!

 

তবু সমালোচকরা যেহুতু সংখ্যায় বেশি তাই সরকার সমর্থকের পক্ষে তাদের সাথে একা পেরে ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছিলো। উনি একটি অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করা মাত্রই প্রতিপক্ষ থেকে ধেয়ে আসছে একাধিক অস্ত্র, যদিও তাতে যুক্তির বালাই কমই আছে! বুঝতে পারছিলাম, পরাজয় মেনে না নিলেও যুক্তি আর অযুক্তির বাক্যবাণে কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো হেরে যাবেন সরকার সমর্থক।

 

ঘড়ির কাঁটায় ৫টা ১৫! সূর্যি মামা আজকের মত বিদায়ের মাহেন্দ্রক্ষণে। গোধূলি লগ্নে তবু কিছুটা আলো বাসের পেছনের গ্লাস দিয়ে বাসের ভেতরে প্রবেশ করছে। এরই মধ্যে বাস প্রবেশ করলো কাশিয়াডাঙ্গা চেকপোস্ট (বাসের সময় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ) পেড়িয়ে লোকমুখে চর্চিত প্রজাপতি সড়কে! রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক বাতি গুলো তখনো জ্বলেনি।

 

স্নিগ্ধ নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, রক্তিম সূর্যের লালাভ আভা ছুঁয়ে যাচ্ছে সড়ক বিভাজকে স্থান পাওয়া নানা প্রজাতির গাছগুলোর ফুল ও পাতার পাশাপাশি সদ্য স্থাপিত কৃত্রিম প্রজাপতির ডানা! রাস্তার পাশে ফুটপাতে থাকা বাহারি রঙ্গের টাইলসগুলো যেন জানান দিচ্ছে নিজের আভিজাত্য। সবকিছু মিলিয়ে এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য!

 

তখনও চলছে বাসে সেই টকশো। নিশ্চিত হারের সমুদ্রে ডুবতে থাকা সরকার সমর্থকটি প্রজপতি সড়কে প্রবেশ করতেই যেন পায়ের নিচে মাটি পেলেন। চোখের সামনে উন্নয়নের এমন জলজ্যান্ত প্রমানপত্র পেলে আর কিইবা লাগে? এতক্ষণ যিনি পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, স্যাটেলাইট-সাবমেরিনের গল্প বলেও হালে পানি পাননি, সেই তিনি এবার শুরু করলেন গত কয়েক বছরে রুপকথার মত বদলে যাওয়া রাজশাহীর উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে। একের পর এক বলে গেলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চলতে থাকা এই শহরের নানা উন্নয়ন কর্মকান্ডের গল্প! সড়ক থেকে অত্যাধুনিক ড্রেনেজ, টাইলসে মোড়ানো সুসজ্জিত পদ্মারপাড় থেকে হাইটেক পার্ক, ফ্লাইওভার থেকে অত্যাধুনিক ওভারপাস বা দৃষ্টিনন্দন সড়ক বাতি, কোনকিছুই বাদ দিলেন না।

 

মজার বিষয়, তার এসব গল্প শুনে সরকার বিরোধী একজন সহ নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকা মানুষটিও যেন ইউটার্ন নিয়ে নিলেন। কট্টর সমালোচকটিও কিছু না বলে চুপচাপ রইলো! টকশো যেন রুপ নিলো ভুল বুঝে বহুকাল দূরে দূরে থাকা কিছু বন্ধুদের মহামিলনে! প্রজাপতি সড়কের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সকলেই যেন মেতে উঠলেন লিটন (এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটন, মেয়র, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন) বন্দনায়। একবাক্যে যেন সকলেই মেনে নিলেন শহরের উন্নয়নে তাঁর অবদান ও শহরের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে তাঁর অবিরাম চেষ্টাকে।

 

নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকা মানুষটি বলে উঠলো, “মাঝের পাঁচ বছর অন্য কেউ না থাকলে এতদিন আমরা আরো এগিয়ে যেতাম। তারপরও এত অল্প সময়ে যা হয়েছে, তা অনেক। চোখের সামনে এত উন্নয়ন আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। সব কিছুই রুপকথার মত মনে হয়। এই শহরে এসে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষ পাওয়া যাবেনা। তাছাড়া করোনার সময় মেয়র সাহেব যেভাবে শহর ও শহরের মানুষগুলোকে আগলে রেখেছিলেন, সেটাও গর্বভরে গল্প করার মতন। আসলে সবই রক্তের খেল। বাবা (শহীদ এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান হেনা) মানুষের কল্যানে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে এক বিন্দু ভাবেননি, কখনো ভয় পাননি শত্রুপক্ষের রক্তচক্ষুকে, তাঁর সন্তান তো এমনই হবেন।”

 

সরকারের সমালোচনা করতে থাকা আরেকজনও তার সুরেই বলে উঠলো, “এটা ঠিকই। যেভাবে লিটন সাহেব শুরু করেছিলেন, মাঝে ৫ বছরের ঐ ছেদটা না পড়লে এসব কাজ তখনই হতো।”

 

এতক্ষণ সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকান্ডকে যিনি অযুক্তির আশ্রয়ে বিতর্কিত করেছেন, এতক্ষণ যিনি স্যাটেলাইট আর পারমানবিক প্রকল্পের মাহাত্ম্যকে বালিশ আর পর্দাকান্ড দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তিনি লিটনের উন্নয়নের গল্পে তখনও চুপ। ভাবলাম চুপচাপ বসে এই উন্নয়নের মাহাত্ম্যকে ছোট করার জন্য আবার নতুন কোন অযৌক্তিক কুট কৌশল খুঁজছেন! কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো উগড়ে দিবেন সব, এতক্ষণ যেভাবে দিচ্ছিলেন।

 

নাহ, তিনি তা করলেন না। চুপচাপই রইলেন। আর মাঝে মাঝে প্রতিপক্ষের “আপনিই বলেন?” প্রশ্নের উত্তরে কেবলি সম্মতিসূচক “না, তা ঠিক” বলে গেলেন। তবে সরকারের এমন কট্টর সমালোচকও যে এভাবে সবকিছু মেনে নিবেন, তা ভাবতেও পারিনি।

যে মানুষটি দুুর্নীতি আর অনিয়মের ধোঁয়া তুলে সরকারের মেগা প্রজেক্টগুলোকেই বিতর্কিত করার চেষ্টা করে গেছেন এতক্ষণ, রুপকথার মত বদলে যাওয়া রাজশাহীর উন্নয়নে মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের অবদানের প্রশ্নে সেই মানুষটিরই এমন সরল স্বীকারোক্তি দেখে কেবল দুটি প্রশ্নই মনের মাঝে ঘুরপাক খেতে শুরু করলো, ‘চোখের সামনে থাকা ধ্রুব সত্যকে তিনি অস্বীকার করতে পারলেন না?’ ‘নাকি, নান্দনিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে এসে দল মতের উর্দ্ধে উঠে নিরবে প্রশান্তিকে উপভোগ করতে চাইলেন?’ নিজ গৃহের এমন অপরুপ সৌন্দর্য যে পরম প্রশান্তিরই। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই কানে শেষবারের মত ভেসে আসলো হেলপারের কন্ঠ, “রেলগেট, রেলগেট! বাস নওদাপাড়া যাবে, সবাই এখানেই নামেন”।

সানশাইন / শামি


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৭, ২০২১ | সময়: ৬:১৫ অপরাহ্ণ | সুমন শেখ