রাজশাহীতে ‘স্যালাইন দেওয়ার পর’ চার প্রসূতির মৃত্যু, গোপনে রফাদফার চেষ্টা

স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহীতে স্যালাইন দেওয়ার পর অসুস্থ হয়ে চার নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের আগে সম্প্রতি রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাদের এই স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল। এরপর দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়। স্যালাইন দেওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়া দুই নারী এখনও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি রয়েছেন।
এদিকে মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দিতে মারা যাওয়া নারীদের মধ্যে দুই-একজনের স্বজনদের ‘ম্যানেজ’ করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওই স্যালাইন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তবে বিষয়টি জেলার সিভিল সার্জন কিংবা স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ে জানায়নি বেসরকারী এই হাসপাতালটি।
হাসপাতালের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সম্প্রতি সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার আগে আইভি স্যালাইন দেওয়ার পর ছয়জন নারীর একই রকম শারীরীক সমস্যা শুরু হয়। অস্ত্রোপচারের পর ধীরে ধীরে তাদের শারীরীক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তাদের কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়। হার্টে ব্লক দেখা দেয়। এতে চারজন নারীর মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে দুজন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তবে সূত্রটি ওই নারীদের নাম-পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য হাসপাতালটির পরিচালক ডা. সানাউল হক মিয়াকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। হাসপাতালের ইনচার্জ ইলিয়াস হোসেনকে শুক্রবার তার অফিসে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, ‘ঘটনা তদন্তে কমিটি হয়েছে। তারা কাজ করছেন।’ মৃত নারীদের নাম-ঠিকানা জানতে চাইলে ইলিয়াস হোসেন জানাননি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত নারীদের তথ্য না দিলেও খোঁজ নিয়ে দুজনের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। তাদের একজন রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার আনুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা আসমা খাতুন (৩৮)। আসমার স্বামী আফজাল হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার আরও এক নারীর বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। ওই নারীর স্বামী তাঁর কিংবা স্ত্রীর নাম-পরিচয় জানাতে চাননি। তিনি বলেছেন, ‘ভাগ্যে মৃত্যু ছিল, হয়ে গেছে। এসব বলে আর লাভ নাই।’
মারা যাওয়া আসমা খাতুন একটি বেসরকারী সংস্থার রাজশাহীর পবা উপজেলা শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন। তার স্বামী আফজাল হোসেন জানান, আসমা প্রথমবার গর্ভধারণ করেছিলেন। একবছর ধরে প্রতিমাসেই তিনি ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. সুলতানা নাজনীন রিতার কাছে চেকআপ করাতেন। সন্তান প্রসবের সময় হলে গত ১৯ মার্চ সন্ধ্যায় স্ত্রীকে হাসপাতালটিতে ভর্তি করেন। ভর্তির পর তাঁর স্ত্রীকে একটি স্যালাইন দেওয়া হয়। এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাঁর স্ত্রী সন্তানের জন্ম দেন। ধীরে ধীরে তাঁর স্ত্রীর শারীরীক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়।
রাত ৪টার দিকে চিকিৎসকেরা জানান, আসমার দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে পড়েছে। হার্টের কার্যক্ষমতাও কমে গেছে। আফজাল হোসেন তখন বলেন, গর্ভধারণের পুরোটা সময়ই তিনি মাসে মাসে স্ত্রীকে চেকআপ করিয়েছেন। তখন কোন সমস্যা ধরা পড়েনি। হঠাৎ করে এখন এত সমস্যা কেন? চিকিৎসকেরা তখন জানান, এটা স্যালাইনের পাশর্^প্রতিক্রিয়া।
আফজাল হোসেন জানান, ওই রাতেই ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব লোক ও অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে আসমাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ১৫ মিনিট পর আসমা মারা যান। আফজাল জানান, আসমার মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মোটা টাকার বিনিময়ে আপস করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে তিনি আপস করতে চান না। তিনি স্ত্রীর অপমৃত্যুর বিচার চান। এ নিয়ে তিনি মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন।
ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সুলতানা নাজনীনী রিতার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। ঘটনা তদন্তে গঠিত ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান হাসপাতালটির সার্জারী বিভাগের প্রধান ডা. আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, ‘স্যালাইন দেওয়ার পর কয়েকটা রোগীর ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে। আমরা শুধু আসমা খাতুনের ব্যাপারটা তদন্ত করছি। ওই স্যালাইনটা আর ব্যবহার করা হচ্ছে না। এটা পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।’
রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মো. ফারুক বলেন, ‘কিছুক্ষণ আগে ঘটনাটা শুনলাম, সেটাও অন্য মাধ্যমে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছু জানায়নি। আমরা সব তথ্য চেয়েছি হাসপাতাল থেকে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। হাসপাতালের গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. আনোয়ারুল কবির বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগকে ঘটনাটি না জানিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অন্যায় করেছে। এটা খুবই স্পর্শকাতর ব্যাপার। আমাদের জানানো উচিত ছিল। আমরা জানতে পারলে আমাদের মতো করে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারতাম। তারা কেন আমাদের কাছে এটা লুকিয়েছে, সেটা খতিয়ে দেখা হবে।’


প্রকাশিত: এপ্রিল ৬, ২০২৪ | সময়: ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ