তানোরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াই চলে ক্লিনিক , প্যাথলজি চালায় কর্মচারী

স্টাফ রিপোর্টার :

রাজশাহীর তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘিরে পৌর এলাকার আমশো মেডিকেল মোড় ও গোল্লাপাড়া বাজার নামক স্থানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে নানা নামের ভুঁইফোড় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সরকারি সব শর্ত উপেক্ষা করে গড়ে উঠা এসব হাসপাতাল ক্লিনিকে কখনো ভুল চিকিৎসা আবার কখনো অপচিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন রোগী।

 

 

যত্রতত্র গড়ে ওঠা বেসরকারি ক্লিনিক ও প্যাথলজি সেন্টারগুলোতে নেই নিজস্ব কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। অথচ প্রতিটি ক্লিনিকে একাধিক চিকিৎসকের নাম ব্যবহার করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দক্ষ টেকনিশিয়ানদের স্বাক্ষর ও সিল ব্যবহার করে প্যাথলজির বিভিন্ন পরীক্ষার প্রতিবেদন দেন সেখানকার কর্মচারীরা। এমনকি মালিক ও কর্মচারীরা চিকিৎসক সেজে চিকিৎসা দেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

 

 

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, পুরো উপজেলায় নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ১১টি। এরমধ্যে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ৫টি। আর শুধু ডায়াগনস্টিক রয়েছে ৬টি। তবে, ওই তালিকার বাইরে আরও দুয়েকটি প্যাথলজি সেন্টার গোপনে অবৈধভাবে ব্যবসা করছে। আর সরকারি নিয়ম অনুসারে একটি বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ১০টি বেডের জন্য সার্বক্ষণিক একজন এমবিবিএস চিকিৎসক ও একজন প্রশিক্ষিত সেবিকা থাকার বিধান রয়েছে। আর প্যাথলজি বিভাগের জন্য স্ব-স্ব সেক্টরে সরকার অনুমোদিত ও প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান।

 

 

কিন্তু এসব নিয়মনীতির কোন তোয়াক্কা না করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গেটের সামনে ‘প্রাইম ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ গড়ে তোলা হয়। যার রেজিঃ নম্বর- ৪৯০২ দেখানো হয়েছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এই ডায়াগনস্টিক সেন্টার শুধু রাজশাহী নগরীর মধ্যে সিমাবদ্ধ। এরপরও নগরীর বাইরে তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গেটের সামনে দেদারসে চলছে অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি। সেখানে দক্ষ টেকনিশিয়ানদের স্বাক্ষর ও সিল ব্যবহার করে প্যাথলজির বিভিন্ন পরীক্ষার প্রতিবেদন দেন সেখানকার মালিক ও কর্মচারীরা।

 

 

সম্প্রতি তানোর গোল্লাপাড়া বাজারে ‘তানোর জেনারেল হাসপাতাল’ নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। তবে, এই হাসপাতালের সাইনবোর্ডের নিচে সরকার অনুমোদিত বেসরকারি হাসপাতাল বলা হলেও নিবন্ধন নম্বর দেয়া হয়নি। এখানেও দক্ষ টেকনিশিয়ানদের স্বাক্ষর ও সিল ব্যবহার করে প্যাথলজির বিভিন্ন পরীক্ষার প্রতিবেদন দেন সেখানকার মালিক ও কর্মচারীরা। এতে প্রতারিত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।

 

 

অপরদিকে, উপজেলার সরনজাই বাজারে গড়ে তোলা হয় গ্রীন কেয়ার নামক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সেখানে উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালতে রাব্বিল ইসলাম নামেক একব্যক্তির ৬ মাসের জেল ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা হয়। পরে জামিনে বেরিয়ে রাব্বিল ইসলাম একই প্রতারণা শুরু করেছেন মহানগর ক্লিনিক ও গ্রীন কেয়ার নামক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এছাড়াও মুন্ডুমালা পৌর সদরে রয়েছে পদ্মা ও আসনারা নামের বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সেখানেও নেই কোন দক্ষ টেকনিশিয়ান। এসব ক্লিনিক, প্যাথলজি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে ডিএমএফ ডাক্তার দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

 

স্থানীয়রা বলছেন, ক্লিনিক ও প্যাথলজি সেন্টারগুলোতে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কোনো নজরদারি নেই। তারা সব সময় প্রভাবিত হন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক ও ম্যানেজার দ্বারা। ফলে ক্লিনিক প্যাথলজি সেন্টার মালিকেরা স্বাস্থ্য  সেবায় সরকারি কোনো নিয়মনীতি মানছেন না। অনিয়ম ও অপচিকিৎসার কারণে মাঝেমধ্যে ঘটছে রোগী মৃত্যুর ঘটনা।

 

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক  স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, তাৎক্ষণিক সেবা নিতে এসে রোগীরা বেশির ভাগ ক্লিনিক ও প্যাথলজি সেন্টারে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। তারা ভালো মানের চিকিৎসকের মাধ্যমে সেবা দেয়ার কথা বলে প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মচারীরা ডাক্তার সেজে রোগীদের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপত্র দেন। এমনকি রোগীদের সিজারিয়ানসহ নানা ধরনের অপারেশন করছেন। আর প্রশিক্ষিত সেবিকার কাজ করানো হয় আয়া ও পিয়ন দিয়ে। এমনই প্রমান পাওয়া গেছে গোল্লাপাড়া বাজারে অবস্থিত এলাহী ডায়াগনস্টিক ও ফিজিও থেরাপি সেন্টারে।

 

নামপ্রকাশে অনিচ্ছূক অনেকে বলেন, এখানে ফিজিও থেরাপি ও প্যাথলজি বিভাগে রোগীদের সঙ্গে আরও বেশি প্রতারণা করা হয়। কর্মচারী দিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করিয়ে এতে অন্য কোনো প্যাথলজিস্টদের স্বাক্ষর ও সিল ব্যবহার করে প্রতিবেদন দেন। এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সিভিল সার্জন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও কোনো সুফল আসছে না।

 

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্যমতে, তানোরে কোনো ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিজস্ব চিকিৎসক নেই। দুয়েকটা ক্লিনিকে ভাড়া করা চিকিৎসক দিয়ে শুধু অস্ত্রোপচার করিয়ে নেন। বাকি কাজ ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা করেন। অথচ ক্লিনিকের সামনে একাধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নাম ব্যবহার করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা আছে। যার বেশির ভাগ ভুয়া চিকিৎসক। অথবা এঁদের মধ্যে যাঁর নাম ব্যবহার করে প্রচারণা করছে, হয়তো ওই চিকিৎসকেরা জানেন না।

 

আবার অনেক ক্লিনিক মালিকেরা নিজেরাই চিকিৎসক সেজে অস্ত্রোপচার করছেন। এতে রোগীরা বিভিন্ন সমস্যায় পড়ছেন। এর ফলে মাঝেমধ্যে কিছু রোগী সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসাসেবার অভাবে মারাও যা”েছ। নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক ক্লিনিক মালিক বলেন, ক্লিনিক ও প্যাথলজি সেন্টারে যেন কোনো হয়রানি বা আইনি জটিলতা না হয় এজন্য সব মালিক মিলে প্রশাসন ম্যানেজ করা হয়। যেকোনো সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক সমাধান করা যায়।

 

 

এব্যাপারে তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডা. বার্নাবাস হাসদাক বলেন, পুরো উপজেলায় ১১টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক রয়েছে। এরমধ্যে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ৫টি। আর শুধু ডায়াগনস্টিক রয়েছে ৬টি। তবে ‘তানোর জেনারেল হাসপাতাল’ নামক প্রতিষ্ঠান ব্যাপারে তিনি অবগত নন। এরপরও কোনো ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অপচিকিৎসা হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান টিএইচও।

 

 

এবিষয়ে রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, তানোরে অনেক ক্লিনিক ও প্যাথলজি সেন্টারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে একটি ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাকিগুলোতে দ্রুত অভিযান চালানো হবে। আর কোনো অবৈধ ক্লিনিক বা প্যাথলজি সেন্টার আছে কি না, সেটা কাগজপত্র না দেখে এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।

সানশাইন / শামি

 


প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২৪ | সময়: ৯:২৭ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine