অভিভাবক কাঁদে, তথ্যপ্রযুক্তির ফাঁদে

 ফিচার  নিউজ : 

মেয়ে লেখাপড়া করে ভাল মানুষ হবে, দরিদ্র ভ্যানচালক বাবা ও দিনমজুর মার মনে কত আশা, কত স্বপ্ন। তারা দিনকে রাত রাতকে দিন করে চলেছেন মেয়ের লেখাপড়া ভালভাবে চালানোর উদ্দেশ্যে। নিদারুণ করোনাকালে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় যখন অনলাইন ক্লাসের আয়োজন হল, তখন উপায়ান্তর না পেয়ে বাবা তার একমাত্র আয়ের সম্বল ভ্যান বিক্রী করে অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ের জন্য উপযুক্ত মোবাইল কিনে দেন। মোবাইলে ক্লাস করার উপযোগী করে মেয়ের রুমটিও যথাসম্ভব সাজিয়ে দেন। মেয়ে দরজা বন্ধ করে ক্লাস করতে লাগল। এক সময়ে করোনার উপদ্রব শেষ হল। মেয়ের রুমের দরজা মাঝে মাঝে খুললেও মনের দরজা আর খুলল না। রাজশাহীর একজন প্রবীণ শিক্ষক করোনাকালে শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল ওঠে যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে বলছিলেন তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা।

 

লেখক –  ছবি

 

একজন অভিভাবক আমাকে বলেছেন, বাসায় আত্মীয় আসার পর ছেলেকে রীতি অনুয়ায়ী শ্রদ্ধা জানানো ও কুশলাদি বিনিময়ের অনুরোধ করলে সে জবাব দিয়েছে, আগত আত্মীয়ের সাথে কেবল গতকালই তার মেসেঞ্জারে কথা হয়েছে, এখন তার ওঠা সম্ভব নয়, কারণ মোবাইলে সে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে রয়েছে! তাই এই মুহুর্তে তাকে অন্যমনস্ক করা যাবে না বলে মাকে বিরক্তির সুরে জানিয়ে দেয়। মোবাইলের ব্যবহার কমানোর জন্য মা ছেলেকে বলে বলে ধৈর্যহারা হয়ে যেদিন শাসকের ভূমিকায় আসলেন, সেদিন পেলেন পাল্টা হুমকি; ছেলে বলল, বেশী বাড়াবাড়ি করলে সে সাততলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বে। অপর একজন অভিভাবক ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলেন এদের মানসিক প্রসারতা লাভের আশায়। ছেলেমেয়ের মন্তব্য: এসব দেখার জন্য তো এত টাকা ও সময় নষ্ট করে এখানে আসার কোন প্রয়োজন ছিল না- ইন্টারনেটে এর চেয়েও বেশী কিছু পাওয়া যায়! তারা ঘোরাঘোরির চেয়ে বাসায় বসে থাকাটাকে (আসলে ইন্টারনেটভিত্তিক বিনোদন!) শ্রেয়তর মনে করে। এরকম ঘটনা আজ নিত্যদিনকার। অভিভাবকরা অসহায়ত্ব বোধ করছেন, পারিবারিক জীবনের হতাশা ক্রমেই বেড়ে চলছে।

 

 

অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় যে, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের গোটা সামাজিক গঠনকেই পাল্টে দিচ্ছে। এ যুগের তরুণ প্রজন্ম আবহমান সামাজিকতা বুঝতেই চায় না। তারা ইন্টারনেট দেখে দেখে নিজেদের মত যার যার দৃাষ্টভঙ্গী তৈরী করছে, একজনের সাথে আর একজনের দৃষ্টিভঙ্গী মিলছে না। বন্ধু-বান্ধব একসঙ্গে বসছে কিন্তু তেমন কথাবার্তা নেই, কারণ সবার হাতেই তো মোবাইল! পারিবারিক আড্ডা আজ প্রায় বিলীন। একসাথে বসে পরিবারের সকলের খাবার গ্রহণের ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তপ্রায়। পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সকলের মতামত জানার জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করার মতই অবস্থা চলে এসেছে প্রায়। পরিবারের কেউই বাড়ীর বাইরে নয়, তথাপি সামনা সামনি বসা হয় না।

 

 

সেবা সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউণ্ডেশন’ বছর সাতেক আগে এক সমীক্ষায় পেয়েছে যে, অষ্টম-ম্বাদশ শ্রেণীতে পড়ুয়াদের মধ্যে ৭৭ শতাংশই পর্ণোগ্রাফিতে আসক্ত। এতে অল্প বয়সে এদের মধ্যে তৈরী হচ্ছে যৌন চাহিদা। ইন্টারনেট চালানোর টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে এরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অবৈধ কাজ-কারবারে। অসামাজিক ও অনাকাঙ্খিত ঘটনার বিস্তৃতি ঘটছে এভাবেই। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এই সমস্যা বিশ্বব্যাপী। ইউনিসেফ-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর প্রতি তিন জনে একজন শিশু। প্রতিদিন ১,৭৫,০০০ শিশু (প্রতি সেকেণ্ডে ২ জন) ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী দৈনিক ছয় থেকে আট ঘন্টা বা এরও অধিক সময় এ কাজের পেছনে ব্যয় করে থাকে। শুধু শিশুদেরকে দায়ী করলে চলবে না। বিরাট সংখ্যক বড়দেরও বিনোদনের মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে মোবাইল তথা ইন্টারনেট। সামাজিক যোগাযাগের মাধ্যম হিসেবে বহুল পরিচিত এই কালো সাপ গোটা সমাজকেই গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে।

 

 

এহেন পরিস্থিতি নিরীক্ষণ করে অধ্যাপক প্রাণগোপাল দত্ত (বর্তমানে জাতীয় সংসদ সদস্য) ইন্টারনেট ব্যবহারের কুফল সম্পর্কেূ সতর্ক করে বলেছেন, ‘‘মোবাইল ফোন শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ভীষণ ক্ষতি করে। সেদিন খুব বেশী দূরে নয়, যেদিন মোবাইল ফোনকে সিগারেটের চেয়ে ব্শেী ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।” আর, দৃশ্যমান ক্ষতির মধ্যে রয়েছে ছেলে বা মেয়ের আত্মকেন্দ্রীকতা, রুক্ষতা, একাকীত্ব, ভিন্ন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা তৈরী না হওয়া, অসহিষ্ণুতা, অস্থিরতা প্রভৃতি মানসিক সমস্যা। যে বিষয়টি আমার কাছে সবচেয়ে ভয়াবহ মনে হয়েছে, তা হল ভবিষ্যত সমাজের পরিচালকদের সৃষ্টিশীলতা ধ্বংস হয়ে যাওয়া, কারণ এরা আবদ্ধ হয়ে পড়েছে একেবারেই ছোট কক্ষের মধ্যে। বিশ্বকে হাতের মুঠোয় পুরতে গিয়ে নিজেরাই নিজেদের তালুবন্দী হয়ে যাচ্ছে। বিবেক, মানবিকতা, সহমর্মিতা, দয়ামায়া, দায়দায়িত্ব প্রভৃতি শব্দ এদের অভিধান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

 

 

আমাদের বর্তমান আলোচ্য বিষয় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমানে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা ভবিষ্যত প্রজন্মের উপকারে তথা মানব সমাজের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কতটুকু সহায়ক বা প্রতিবন্ধক হতে পারে, এর একটি প্রাথমিক ধারণা প্রণয়ন করা। আমার মনে হয় এ বিষয়ে আর কোন কথা না বলাই শ্রেয়। আমাদের ছেলেমেয়েরা অবশ্যই প্রযুক্তির ব্যবহারে পারদর্শী হবে; কিন্তু এর সময় আছে, সীমা আছে। যে শিক্ষা মানুষকে তার মানবিক গুণাবলী থেকে বের করে নিয়ে আসে, সে শিক্ষা তো কারো কাম্য হতে পারে না।

 

 

আমার ধারণা, স্কুল-কলেজে ছেলে বা মেয়ে পড়াশোনা করে, অথচ মোবাইলের যথে”ছ ব্যবহার নিয়ে অনুতাপ ও বিতণ্ডা নেই, এমন অভিভাবক খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিভিন্ন আলোচনায় শুনি, অভিভাবকদের সজাগ হওয়া আবশ্যক। কিন্তু পরিস্থিতি অনেকটাই অভিভাবকদের আয়ত্বের বাইরে চলে গিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জাতীয়ভাবে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা আজ সময়ের বিশেষ দাবী হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। নতুবা অভিভাবকদের নীরব কান্না একদিন চরম আকার ধারণ করতে পারে।
বাবুল চন্দ্র সূত্রধর
গবেষক,মানবাধিকারকর্মী

সানশাইন / শামি


প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২৪ | সময়: ৭:৩৮ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine