সর্বশেষ সংবাদ :

দেশ-বিদেশে কদর বাড়ছে চলনবিলের শুঁটকির,  ২৫০ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা 

সিংড়া প্রতিনিধি :

দেশ-বিদেশে চলনবিলের মিঠা পানির মাছের শুঁটকির কদর বাড়ছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে শুঁটকির বাণিজ্যেও নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। দেশের বাজার ছাড়িয়ে ভারতেও রপ্তানি হচ্ছে চলনবিলের প্রচুর পরিমাণে শুঁটকি।

স্থানীয় শুঁটকি ব্যবসায়ীরা বলছেন, লবণ ছাড়া অন্য কোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করায় এখানকার শুঁটকির চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ছেই। মপ্রতি বছরই চলনবিল অধ্যুষিত নাটোরের সিংড়া থেকে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় ছোট-বড় মাছ আহরণ করা হয়। এই মাছের একটি বড় অংশ অবিক্রিত থেকে যায়। এই অবিক্রিত মাছ থেকেই তৈরি হয় শুঁটকি। আর ক্রমেই সিংড়ার মিঠাপানির মাছের শুঁটকির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে মানুষের।

এখন বেশ চড়া দামেই এসব শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে। সিংড়ায় চারটি বড় চাতালসহ ৩০টি এলাকায় বিলের মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকি তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত আছে ৩ শতাধিক মানুষ।

শুঁটকি কেনাবেচার সঙ্গে জড়িতরা জানান, প্রতিবছর ভরা বর্ষায় বিলের নতুন পানিতে প্রচুর দেশি মাছ বংশবিস্তার করে। যে কেউ হাঁটুপানিতে নেমেই এসব মাছ ধরতে পারে। এসব মাছ রান্না করে খাওয়ার পরও অবশিষ্ট থাকে। তখন বাজারেও সস্তায় বিক্রি হয় মাছগুলো। সস্তায় কেনা মাছগুলোই শুকানো হয় শুঁটকির জন্য।

নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের নিংগইন শুঁটকি চাতাল ঘুরে দেখা যায়, টাকি, শোল, পাতাসি, চান্দা, পুঁটি, টেংরা, কই, চিংড়িসহ হরেক প্রজাতির দেশি মাছ কেটে বাঁশের মাঁচায় শুকাতে দেয়া রয়েছে। চাতালের পাশে ছাউনির নিচে মাছ নিয়ে বসেছেন কয়েকজন নারী। তারা মাছ কেটে টুকরিতে রাখছেন। মাঁচায় দেওয়ার আগে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নেওয়া হচ্ছে মাছগুলো।

 

মাঁচায় থাকা ভেজা মাছগুলোও এপিঠ-ওপিঠ উল্টে রাখছেন কেউ কেউ। চাতাল ঘরে রাখা শুঁটকিগুলো আবার রোদে শুকানো হচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ কাটা, বাছাই, ধোঁয়া, রোদে শুকানো, মাঁচা থেকে চাতালে তোলার কাজে শ্রমিকেরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। মহাসড়কের পাশে মাঁচার ওপর শুঁটকির পসরা সাজিয়ে বিক্রিও করছেন কেউ কেউ। গাড়ি থামিয়ে অনেকেই কিনে নিচ্ছেন শুঁটকি।

 

 

বিক্রেতারা বলেন, রাইকোর ৫০০ টাকা, পুঁটি ৬০০ টাকা, টেংরা ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা, টাকি ৮০০ টাকা, চাপিলা ৮০০ টাকা, মলা ৮০০ টাকা ও বাইম ১১০০ টাকা, কাঁচকি ৯০০ টাকা, চান্দা ৯০০ টাকা, চেলা ১০০০ টাকা, পাতাসি ১২০০ টাকা, বোয়াল ১৩০০ টাকা, শৈল মাছের শুঁটকির কেজি আকারভেদে ১৬০০ টাকা, টেংরা দেশি ১৬০০ টাকা, গুচি আকারভেদে ১৩০০ থেকে ১৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

 

তবে মাছের স্বল্পতার কারণে বিলের চিংড়ি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। দেশি চিংড়ি মাছ খুবই সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে তোলা মাত্র তা বিক্রি হয়ে যায়। শুঁটকি তৈরির জন্য চাতাল পর্যন্ত চিংড়ি আর আসে না।

শুঁটকি ব্যবসায়ীরা বলেন, এই এলাকায় প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মণ শুঁটকি বিক্রি হয়। তবে সিংড়ার শুঁটকিগুলোর বেশির ভাগ চলে যায় নীলফামারীর সৈয়দপুরের শুঁটকি বাজারে। এছাড়া রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, দিনাজপুর, কক্সবাজার, রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এখানে এসে শুঁটকি কিনে নিয়ে বিক্রি করেন। এখানকার শুঁটকি প্রস্তুত লবণ ছাড়া অন্য কোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করায় চাহিদা বাড়ছে। তবে ভারতে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করা হয় চলনবিলের শুঁটকি।
সৈয়দপুরের শুঁটকি ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার বলেন, এখানে কোনো ধরনের রাসায়নিক না দেওয়ায় সৈয়দপুরের শুঁটকির বাজারে সিংড়ার শুঁটকির চাহিদা বেশি।

শুঁটকি চাতাল মালিক নাসির উদ্দীন বলেন, পর্যাপ্ত উৎপাদন হলেও এখনো স্থানীয় বাজার সৃষ্টি হয়নি। সড়কের ধারে চাতাল থেকে শুঁটকি কিনতে পারেন না অনেকেই। ফলে বিক্রি কমে গেলে শুঁটকিগুলো কখনো কখনো জেলার বাইরের মোকামগুলোয় নিয়ে যেতে অনেক বেশি খরচ পড়ে। তখন লাভের পরিমাণ কমে যায়।

 

শুঁটকি ব্যবসায়ী জমির উদ্দীন বলেন, মাছ রাখার একটা জায়গা আমাদের খুব দরকার। বর্ষাকালে পানির দামে যেসব মাছ বিক্রি হয়, সেগুলো শীতকাল পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে পারলে সারা বছর শুঁটকি বিক্রি করা সম্ভব।
শুঁটকি ক্রেতা শারমিন খাতুন বলেন, এখানকার শুঁটকি খুবই সুস্বাদু হওয়ায় নিয়মিত কিনে খাই। আর হাতের নাগালেই পাওয়া যাচ্ছে শুঁটকিগুলো। কেনার জন্য দূরে যেতে হচ্ছে না।

 

সিংড়া সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহাদত হোসেন বলেন, স্থানীয় জেলে ও চাতাল মালিকদের দাবীর প্রেক্ষিতে শুঁটকি পল্লী স্থাপনের বিষয়ে কাজ করছি। শুঁটকির সম্ভাবনার ব্যাপারে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখছি। দেশের বাজার ছাড়িয়ে ভারতে প্রচুর পরিমাণে চলনবিলের শুঁটকি রপ্তানি হয়। তিনি আরও বলেন, এ বছর ২৫০ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করছি এতে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার কেনাবেচা হবে।

 


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০২৩ | সময়: ১০:২৬ অপরাহ্ণ | Daily Sunshine