দুর্গাপূজার প্রথম মন্দির আজও অবহেলিত

মাহফুজুর রহমান প্রিন্স, বাগমারা: সনাতন ধর্মালম্বীদের তীর্থস্থান তাহেরপুর আজও অবহেলতি। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ও নিদর্শনের নানান স্মৃতিবিজরিত তাহেরপুরকে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবী আজো বাস্তবায়িত হয়নি। সেই সাথে দূর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল হিসাবে তাহেরপুরকে স্বীকৃতিও দেয়া হয়নি।
অনেক পূজা পার্বনের রীতি থাকলেও শারদীয় দূর্গাপূজাই বেশি আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে পালনকরা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা প্রথম শুরু হয় রাজশাহী জেলার তাহেরপুরে। ৫৩৮ বছর আগে সম্রাট আকবরের শাসনামলে তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ সে সময় ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রথম শুরু করেন দুর্গাপূজা। এই দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল হিসেবে তাই গর্ববোধ করেন তাহেরপুরের অধিবাসীরা।
দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল হিসেবে ইতিহাস খ্যাত তাহেরপুর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পুণ্যভূমির স্বীকৃতি আজও পায়নি। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক নেতারা অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
তাদের মতে, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে তাহেরপুরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা গেলে প্রতিবছর শারদীয় দুর্গাপূজার সময় সারাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের মিলনমেলায় পরিণত হতো স্থানটি।
এদিকে ১৪৮০ সালে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে রাজা কংস নারায়ণ তাহেরপুরের জমিদার তাহের খানকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। ঐতিহাসিক মতে এই যুদ্ধ জয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে রাজ পুরোহিত রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শে রাজা কংস নারায়ণ দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। তার আহ্বানে মা দুর্গা স্বর্গ থেকে সাধারণ্যে আবির্ভূত হন। সেই সময় ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে কংস নারায়ণ প্রথম যে দুর্গা পূজার আয়োজন করেন, সেই প্রতিমা ছিল সোনার তৈরি।
এরই ধারাবাহিকতায় আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হিসেবে দুর্গাপূজা স্বীকৃত। দুর্গাপূজার গোড়ার কথা কালক্রমে যাতে হারিয়ে না যায় সে জন্য তাহেরপুরে রাজা কংস নারায়ণ প্রথম দুর্গাপূজা সৃষ্টি, মন্দির ও জায়গা রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়েছিল।
এ কমিটি দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল তাহেরপুরকে বাঙালী হিন্দুদের শারদীয় উৎসবের পুণ্যস্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেতে বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারের কাছে আবেদন করেও স্বীকৃতি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছেন। সে সময় আধুনিক দুর্গোৎসব পদ্ধতি পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী প্রণীত। এ মহাযজ্ঞের প্রথম অনুষ্ঠান হয়েছিল রাজা কংস নারায়ণ রায়ের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ষোড়শ শতাব্দির শেষ ভাগে। অনুষ্ঠানের স্থানটি ছিল বারনই নদীর পূর্ব তীরে রামরামা গ্রামের দুর্গামন্দিরে। প্রথম দুর্গাপূজার সেই স্থানটি এখন ধ্বংসস্তুপ। এলাকাবাসী স্থানটি সংরক্ষণ করে ধর্মীয় তীর্থস্থান ও পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক অনিক মাহমুদ জানান, তাহেরপুর ছিল রাজা কংস নারায়ণের সাংস্কৃতিক রাজধানী। এখানে বসে কৃত্তিবাস রামায়ণের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। ঐতিহাসিক এ স্থানে প্রতিবছর দুর্গাপূজার সময় জাতীয় উৎসব পালনের দাবি করেছেন তিনি। তাহেরপুরে পর্যটকদের তীর্থস্থান করার দাবিতে ২০০২ সালে গঠিত কমিটির সম্পাদক সঞ্জীব রায় মিন্টু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দফতরসহ বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেন। কিন্তু পুণ্য ভূমি হিসেবে স্বীকৃতি তো দূরের কথা, এখানে উন্নতমানের একটি মন্দিরও সরকারের পক্ষ থেকে নির্মিত হয়নি।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আক্ষেপ করে বলেন, জনপ্রতিনিধিরা ভোটের আগে হিন্দুদের অনেক মিথ্যা আশ্বাস দেন। কিন্তু ভোট চলে গেলে আর মনে রাখেন না। এখানকার রাজবাড়ী গোবিন্দমন্দিরে একটি বৃহৎ শিলালিপি রয়েছে। এতে দুর্গাপূজার প্রতিষ্ঠা, স্থান, সন, তারিখ ও অতীত অনেক কিছু ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ শিলালিপি ছাড়া এখানে আর তেমন নিদর্শন নেই। তাহেরপুরের দুর্গাপূরীতে দেবী দুর্গার মূল বেদীপর্যন্ত এখন নেই।
বর্তমানে দুর্গাপূরীর বেদীমূলে স্থাপিত হয়েছে তাহেরপুর কলেজ। তার পাশে তিনশ বছরের প্রাচীন গাছটির নাম না জানার কারণে ‘অচিনবৃক্ষ’ হয়ে কালের স্মৃতি বহন করছে। তবে হিন্দু শাস্ত্রীয় মতে, মা দুর্গার জন্ম স্বর্গে। সব দেবতার মহা তেজশক্তি নিয়ে মহাপরাক্রমশালী মহিষাসুরকে বধ করার মানসে ত্রেতা যুগে রাবনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দশরথ পুত্র মহামতিরাম মা দুর্গার অকালবোধন পূজা করেন। মা দুর্গা তার পূজায় সন্তুষ্ঠ হয়ে রাবন বধের বর প্রদান করেন। বর পেয়ে রাম লংকা রাজ রাবনকে বধ করতে সক্ষম হন।
সম্প্রতি তাহেরপুরের দুর্গপুরী গোবিন্দ বাড়ি মন্দিরের সভাপতি নিশিত কুমার সোনা সাহা ও সাম্পাদক রঞ্জিব কুমার রায় জানান, ঐতিহাসিক এ স্থানটিকে পুণ্যভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হলে এখানে পর্যটন নগরী গড়ে উঠবে। সারা বিশ্বের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের প্রতি বছর ঢল নামবে এখানে।
তাহেরপুর পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ জানান, আমরা ঐতিহাসিক তাহেরপুরকে একটি পর্যটন কেন্দ্র ও ধর্মীয় তীর্থস্থান হিসাবে গড়ে তোলার ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।
এ উপলক্ষ্যে এখানে অনেক স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে একটি আধুনিক মানের হোটেল নির্মাণের জন্য আমরা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আমন্ত্রন জানিয়েছি।


প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০২৩ | সময়: ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ