চলনবিলে মাছের সংকটে শুটকির উৎপাদন ব্যাহত

তাড়াশ প্রতিনিধি: চলনবিলে মাছের সংকটে শুঁটকি উৎপাদন ব্যাহত চলনবিল অঞ্চলে প্রায় ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি জলাশয় ও ১৬টি নদীর সমন্বয়ে এ বিলের প্রায় সাড়ে চার হাজার হেক্টর জলাভূমিতে মাছ আহরণ করা হয়। এখানে আহরণ করা মাছ থেকে উৎপাদিত শুটকি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রায় ২৫টি দেশে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু এ বছর চলবিলে মাছ কমে যাওয়ায় শুঁটকি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। যেখানে প্রতিদিন ১০০ মণ কাঁচা মাছের প্রয়োজন শুঁটকির চাতালে, সেখানে সর্বোচ্চ তিন থেকে চার মণ মাছ সংগ্রহ করতে পারছেন শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।
উত্তরাঞ্চলের তিন জেলার (সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর) বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে বৃহৎ চলনবিল। বিলের বিশাল জলাভূমি একদিকে যেমন অন্যতম বড় শস্যভাণ্ডার, অন্যদিকে মাছেরও বড় জোগান আসে এখান থেকেই। বৃহত্তর চলনবিলের উৎপাদিত দেশীয় মাছের শুটকি কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ বছর বিলম্বিত বর্ষায় চলনবিলে দীর্ঘমেয়াদি পানি না থাকায় ও বাদাই জাল দিয়ে মা মাছ মেরে ফেলায় নদ-নদী ও বিলের মাছের বংশবিস্তার ব্যাহত হয়েছে। এতে প্লাবন ভূমিতে মাছের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় শুটকি মৌসুমে মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। এ বছর চলনবিল অঞ্চলে শুটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, চলনবিল অঞ্চলে প্রায় ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি জলাশয় ও ১৬টি নদীর সমন্বয়ে এ বিলের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে মাছ আহরণ করা হয়। এটি দেশের মিঠা পানির মাছের বড় উৎস। আর এখানকার বিভিন্ন প্রজাতির মাছকে কেন্দ্র করে চলে কর্মব্যস্ততা। প্রতি বছরের আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কর্মতৎপর হয়ে ওঠে এখানকার শুঁটকিপল্লির চাতালগুলো। এই জনপদের নারী-পুরুষ ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে চলনবিলের শুঁটকি তৈরিতে নেমে পড়েন। এখানে দেশীয় পদ্ধতিতে শুঁটকি তৈরি করা হয়।
তাড়াশের মহিষলুটি মাছের আড়ত, চাটমোহর উপজেলার বোয়ালমারি, সিংড়া বাজারসহ বিভিন্ন আড়ত থেকে মাছ ক্রয় করা হয়। এরপর তা পৌঁছে যায় শুঁটকির চাতালে। এসব চাতালে শোল, বোয়াল, খলসা, টাকি, টেংরা, পুঁটি, কই, শিং, মাগুর, রূপচাঁদা, ডানকোনা, রয়না, বেলে, সরপুঁটি, ছোট চিংড়ি, বাইম, চাপিলা, চেলাপুঁটি ও চাঁদা মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়। আর এখান থেকে তৈরি করা শুঁটকি সৈয়দপুর, নীলফামারী, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায়।
স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ২৫টি দেশে শুঁটকি রপ্তানি হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের মহিষলুটি শুটকির চাতালে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে বিভিন্ন স্থানে শুটকি তৈরির চাতাল। কয়েকটি চাতালে সামান্য পুঁটি মাছ রোদে শুকানো হচ্ছে। অন্যগুলোতে সব চাটাই গোছানো।
উল্লাপাড়া উপজেলা থেকে আসা শুটকি চাতাল মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এ বছর আশঙ্কাজনকহারে বিলের মাছ কমেছে। আড়তে মাছ পাওয়া গেলেও মাছের দাম অনেক বেশি।
শুটকির পুরোনো ব্যবসায়ী ও চাতাল মালিক আলম আলী বলেন, চলনবিলে এ বছর বর্ষা কম হওয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মাছ ধরা পড়ছে না। এ ছাড়া মহিষলুটি আড়তেও তেমন মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন ১০০ মণ কাঁচা মাছের প্রয়োজন শুঁটকির চাতালে। অথচ সর্বোচ্চ তিন থেকে চার মণ মাছ সংগ্রহ করতে পারছি। তাও আবার বেশি দামে মাছ কিনতে হচ্ছে। এ বছর ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ।
শুটকি ব্যবসায়ী আলমাছ বলেন, ‘আমরা সাধারণত আড়তের অবিক্রীত মাছ কম দামে কিনে শুঁটকি করে থাকি। কিন্তু এ বছর মহিষলুটি আড়তে তেমন মাছ আসছে না।’
মহিষলুটি মৎস্য আড়তদার রাসেল হোসেন জানান, মাছসংকটের কারণে এখানকার অনেক চাতালের কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হয়নি। শুটকির চাতালে কাজ করা কয়েক শতাধিক নারী-পুরুষ শ্রমিক বেকার অবস্থায় বসে আছেন।
চাতালশ্রমিক তারা খাতুন বলেন, ‘প্রতিবছরই আমরা শুটকিপল্লিতে চার থেকে পাঁচ মাস কাজ করে থাকি। প্রতিদিন একজন নারী শ্রমিকের মজুরি ২০০ টাকা আর পুরুষের ৪০০ টাকা। এ বছর অবস্থা ভালো না।
সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহিনূর রহমান বলেন, এ বছর চলনবিলে কয়েক দফায় পানি আসা ও দ্রুত শুকিয়ে যাওয়ার কারণে মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। তবে ভয়ের কোনো কারণ নেই, চাতাল মালিকরা বিভিন্ন জেলা থেকে মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকি উৎপাদন করবেন। সম্পূর্ণ নিরাপদ উপায়ে যাতে শুটকি উৎপাদন করতে পারেন, এ জন্য স্থানীয় মৎস্য অফিস থেকে তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।


প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০২৩ | সময়: ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ

আরও খবর