সর্বশেষ সংবাদ :

সুপ্রীম কোর্টে দেশের প্রথম সাঁওতাল আইনজীবী তানোরের প্রভাত

আসাদুজ্জামান মিঠু : বাংলাদেশের ইতিহাসে সুপ্রীম কোর্টের সাঁওতাল সম্প্রদায়ের থেকে প্রথম আইনজীবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন বরেন্দ্র অঞ্চল হিসাবে পরিচিতি রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুন্ডুমালা পৌর এলাকার কৃতি সন্তান এ্যাডভোকেট প্রভাত টুডু।
হাইকোটে এ্যাডভোকেট প্রভাত টুডু তালিকাভুক্তির রেজাল্ট ২৩ আগস্ট ২০২৩ইং হয়েছে। তার রোল নং ছিল ৩৭৪২। তালিকাভুক্তির পর থেকেই প্রভাত টুডুর এমন অর্জনে পুরো উত্তরবঙ্গের আদিবাসি পল্লিতে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক আনন্দ উল্লাস চলছে পুরো সপ্তাহ জুড়ে।
প্রভাত টুডুকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন উপজেলার আদিবাসি পল্লীগুলোতে নাচে গানে বরণ করছেন সাঁওতাল সম্প্রদায়ে স্থানীয়রা। দেয়া হচ্ছে একের পর এক গণসংবধনা।
দেশের সর্বচ্চ আদালতে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একজন প্রথম আইনজীবী হওয়ার গৌরব অর্জন করাই উত্তরবঙ্গের আদিবাসি নেতারা এক মাইলফলক হিসাবে দেখছেন। তারা বলছেন আদিবাসির বিভিন্ন দাবি-দাবা আদায়ের প্রভাত টুডু বড় ভুমিকা পালন করবে।
গত এক সপ্তহে প্রভাত টুডুকে উত্তরবঙ্গ আদিবাসি ফোরাম আয়োজিত অত্যন্ত ৫টি স্থানে গণসংবধনা দেয়া হয়েছে। স্থানগুলো হলো চাঁপাই সদর আমনুরা মিশন মাঠে তানোর উপজেলার মুন্ডুমালা পৌর বাজার চাঁপাই জেলার রহনপুর স্কুল মাঠ এবং ময়েনপুর আদিবাসি ফোরাম গণসংবর্ধনা দিয়েছেন। আরো কয়েকটি জেলা সংবর্ধনা দেয়া তারিখ চুড়ান্ত আছে বলে জানান আয়োজকেরা।
উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রচার বিষয়ক সম্পাদক প্রদীপ হেমব্রম বলেন, সত্যি এটা খুব গর্বের যে সাঁওতাল সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব একজন নক্ষত্রকে পেল দেশের সর্বচ্চ আদালতে আইনজীবী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এটা আমাদের জন্য যেমন গর্বের তেমনি পুরো উত্তরবঙ্গের জন্য গর্ব। প্রভাত টুডু যদি ঘরে ঘরে তৈরি হয় তাহলে আপনাদের অধিকার আদায়ে সময় লাগবে না।
উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হিংগু মুরমু বলেন, দেশের ইতিহাসে সুপ্রিম কোটে সাঁওতাল এ্যাডভোকেট হয়ে প্রভাত টুডু এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এ সম্প্রদায়কে দেশবাসি নতুন করে চিনবে। তাদের অধিকার আদায় করতে প্রভাত টুডু বিশাল ভুমিকার পালন করবে বলে আমাদের আশা।
প্রত্যন্তঞ্চলে কাদামাখা মেঠোপথ দিয়ে যাওয়া জলাহার গ্রামেই ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে শ্যাম টুডু ও রাজোবালা মুরমু’র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন প্রভাত টুডু। সাত ভাইবোনের মধ্যে প্রভাত টুডু সবার ছোট।
তার জন্মস্থান চাঁপাই সদর উপজেলার জলাহার গ্রামে হলেও তিনি ছোট থেকে বেড়ে উঠেছেন নানার বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুন্ডুমালা পৌরসভার ময়েনপুর খোনাপুকুর গ্রামে।
ছোট কাল থেকেই দুরন্তপনা প্রভাত টুডু অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য কথা বলেন। ক্লাশে ক্যাপ্টেনসীপও করেছেন। ছোটকাল থেকেই বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত। এক সময ভালো ফুটবল সংগঠকও ছিলেন। ‘এভেন’ নামে বিভিন্ন স্থানে ফুটবল টুর্ণামেন্ট আয়োজনের প্রধান কর্তাও ছিলেন। ২০০০ সালে মেট্রিক (এসএসসি) পাশ করার পর মারাত্মক রোড এক্সিডেন্টে তার ডান হাত ভেঙে যায় এবং মাথায় প্রচন্ড আঘাতে পড়াশুনা বন্ধ রাখতে হয়। সুস্থ হয়ে পরবর্তীতে এইচ.এস.সি. ও নটরডেম কলেজ থেকে ডিগ্রী এবং সরকারি বাংলা কলেজ হতে সমাজকর্মে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
কিন্তু প্রভাত টুডুর আইনজীবী হওয়ার প্রবল ইচ্ছে। কিন্তু কিভাবে আইনজীবী হতে হয় কোথাই, কিভাবে, কি পড়লে আইনজীবী হওয়া যায় তা তার জানা নেই। তাই সে দুঃখ করে বলেন, আমি এমন কাউকে পাইনি যিনি আমাকে পরামর্শ দিবেন কিভাবে আইনজীবী হওয়া যায়।
আমি যখন নিজে নিজে জানলাম আইনজীবী হওয়ার পথ তখন ২০১২ সালে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই এবং ২০১৪ সালে এলএলবি ও ২০১৬ সালে এলএলএম সম্পন্ন করি’। এরপর ২০১৭ সালে আয়কর আইনজীবী হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনআরবি) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আয়কর আইনজীবী হিসেবে ঢাকা ট্যাক্সেস বারে সদস্য হন। এদিকে বার কাউন্সিলে পরীক্ষা জটের কারনে ২০১৮ সালে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন ।
এরপর নিম্ন আদালতে ওকালতি করতে করতে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্নার তত্ত্ববাবধানে জুনিয়ারসীপ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্রাকটিসের অনুমতি পরিক্ষায় অংশ নিয়ে ২৩ আগষ্ট ২০২৩ সালে প্রভাত টুডু হয়ে ওঠেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
তিনিই বাংলাদেশের ইতিহাসে সুপ্রিম কোর্টে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মধ্য হতে প্রথম আইনজীবী।
এ্যাডভোকেট প্রভাত টুডু জানান, আমি নিপীড়িত, নির্যাতিত, অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। যারা গরীব অর্থের অভাবে আদালতে যেতে পারছেন না তাদের জন্য কাজ করতে চাই।
ওকালতির পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন কাজে তিনি জড়িত রয়েছেন। তিনি ২০১২ খ্রি. উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন এবং বর্তমান পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেট ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এর ইক্যুয়ালিটি ফেলো এবং বাংলাদেশ খ্রিস্টিষ্টান লইয়াার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএলএ)’র যোগাযোগ ও প্রচার সম্পাদক এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যালাইন্স ডিফেন্ডিং ফ্রিডম (এডিএফ) এবং অ্যাডভোকেটস ইন এশিয়ার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
প্রভাত টুডু আদিবাসীদেরকে শিক্ষিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বলেন, বাংলাদেশে আদিবাসীরা এখনো পিছিয়ে পড়া জাতি হিসেবে চিহ্নিত। শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনীতি, অর্থনৈতিক সাবলম্বীতা এখনও নাই বললেই চলে। আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত অন্যদের কাছে ঠকে। ভূমি দস্যুরা আদিবাসীদের জমি, ভূমি এমনকি বসতভিটা পর্যন্ত গ্রাস করে নিচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিটি পরিবারে যদি ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হয়ে তারা একেকজন পরিবারের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের সম্পদ হবে। তিনি তার সকল শুভাকাক্ষী ও পরিচিতজনদের কাছে দোয়া চেয়েছেন।


প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৩ | সময়: ৫:১০ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ