২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত প্রতিবেদন মূল পরিকল্পনাকারী তারেক, নেপথ্যে খালেদা

সানশাইন ডেস্ক: ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা এখন উচ্চ-আদালতে। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর রায়ে রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক এমপি কাজী মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আর সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। মামলার আসামি সাবেক পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাসহ ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে। আসামিদের মধ্যে কারাগারে আছেন ২৭ জন। ১৪ জন পলাতক। জামিনে আছেন ৯ জন।
এরই মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনে বের হয়ে এসেছে, একুশে আগস্টের সেই বিভীষিকাময় বিকেলের গ্রেনেড হামলার বিষয়টি নিছক একটি সন্ত্রাসী ঘটনা ছিল না। ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার পরিকল্পনা। সেদিন শেখ হাসিনাসহ দলের কয়েকজন নেতার জীবন রক্ষা পেলেও আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ কমপক্ষে ২৩ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। শেখ হাসিনাসহ তিন শতাধিক নেতা-কর্মী গুরুতর আহত হন। তাঁদের অনেকেই সারা জীবনের জন্যে স্বাভাবিক চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়েছেন। মামলার তদন্ত এবং দেশি বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মন্তব্যে বার বার উঠে এসেছে এই ঘটনাটি ছিল রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র। এসেছে দালিলিক সব তথ্য প্রমান।
মিথ্যে দিয়েই তদন্ত শুরু অত:পর একজন শৈবাল সাহা পার্থর গল্প
গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকার সর্বপ্রথম ফাঁসিয়েছিল শৈবাল সাহা পার্থ নামে একজন নিরীহ তরুণকে। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের হার্ডনেট সাইবার ক্যাফে থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়ে একটি দৈনিকে ই-মেইল পাঠানোর নাটক সাজিয়ে ২৫ আগস্ট বোনের বাসা থেকে আটক করা হয় পার্থকে। ৪ দিন অজ্ঞাত স্থানে আটকে নির্যাতনের পর ২৯ আগস্ট সিআইডি ইন্সপেক্টর তাকে আদালতে পাঠিয়ে পর্যায়ক্রমে ১৪ দিন রিমান্ডে বর্বর নির্যাতন করা তাকে। পার্থ যেহেতু ভারতে লেখাপড়া করেছেন তাই তাকে ভারতের চর হিসেবে প্রমাণেরও চেষ্টা করেছিল বিএনপি জামাত জোট সরকার। দীর্ঘ ৭ মাস কারাভোগের পর হাইকোর্টের নির্দেশে ২০০৫ সালের ২৩ মার্চ কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।
মাঠে নামে হাওয়া ভবন: এবার জজ মিয়া নাটক
শৈবাল সাহা পার্থর ঘটনা সাজাতে গিয়ে অনেক অসঙ্গতি গণমাধ্যমে চলে আসে। তাই দ্বিতীয় আরেকটি পরিকল্পনা সাজায় বিএনপি-জামাত সরকার। রমনা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোখলেসুর রহমানকে পরিকল্পনাকারী সাজিয়ে জজ মিয়াকে মূল হামলাকারী বানিয়ে গ্রেফতার করা হয়। ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত ও বিচারের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপের মুখে ২০০৫ সালের ৯ জানুয়ারি নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জজ মিয়াকে গ্রেফতার করে গ্রেনেড হামলায় মামলার অপরাধী হিসেবে দেখানো হয়। চাপ প্রয়োগ করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নেওয়া হয় জজ মিয়ার।
পরে তদন্তে বের হয়ে আসে কীভাবে ক্রসফায়ার ও ফাঁসির ভয় দেখিয়ে সিআইডির কথা শুনতে বাধ্য করা হয় জজ মিয়াকে। জজ মিয়ার স্বজনরা স্বীকার করেন, কথা শুনলে নিয়মিত মাসোহারা দেয়া হবে। সে অনুযায়ী কয়েক মাস টাকা পাওয়ার কথাও তারা স্বীকার করেন। বিএনপি-জামাত প্রশাসনের সিআইডির তিন কর্মকর্তা এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, এএসপি আব্দুর রশীদ এবং এসপি রুহুল আমিন হাওয়া ভবনের নির্দেশে জজ মিয়া নাটক ফেঁদেছিলেন বলে প্রকাশ হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।
তদন্ত প্রতিবেদন: মূল পরিকল্পনাকারী তারেক রহমান, নেপথ্যে খালেদা জিয়া
একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার আদালতের রায় থেকে জানা যায়, এ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল বিএনপির বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আদালতের রায়ে তারেক রহমানকে পলাতক দেখানো হলেও তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ফিরে দেখা: ভয়াল ২১শে অগাস্ট’ শীর্ষক এক সাক্ষাৎকারে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, কীভাবে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে গ্রেনেড হামলা করেছিল।
মূল হামলাকারী: মুফতি হান্নান
২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল হামলাকারী ছিল আফগানিস্থানে তালেবানদের হয়ে যুদ্ধ করা এবং ট্রেনিং নেয়া হারকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ওরফে আবুল কালাম ওরফে আব্দুল মান্নান। ২০০৫ সালের ২৭শে জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এমএস কিবরিয়া হত্যা, ২০০৪ সালের ২১শে মে সিলেটের শাহজালালের মাজারে বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপরে হামলা, ২০০০ সালে গোপালগঞ্জে কোটালিপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভামঞ্চের কাছে বোমা পুতে রেখে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা ঘটনার নেতৃত্ব দেয় এই মুফতি হান্নান। তার জবানবন্দিতে উঠে আসে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার তার দীর্ঘদিনের ইচ্ছার কথা। এই উদ্দেশ্যে সে ১৯ বার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে, যার মধ্যে ৭ বার একক চেষ্টা ছিল।
তার সঙ্গে হাওয়া ভবনের যোগসূত্র ছিল মাওলানা তাজউদ্দীন । তিনি বিএনপি নেতা ও উপ-মন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে রাষ্ট্রীয় সাহায্য প্রার্থনার জন্য মুফতি হান্নান ও মাওলানা তাজউদ্দীনকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের কাছে নিয়ে যান পিন্টু। ২০০৪ সালের ১৪ই আগস্ট বাবর এবং কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত বিএনপির সংসদ সদস্য শাহ মোহাম্মদ কায়কোবাদ পুরো পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে তারেক রহমানের সঙ্গে। পরিকল্পনার নেতৃত্বে আসে হাওয়া ভবন।
হাওয়া ভবন থেকে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পরের দিনই মুফতি হান্নানের ডাক পড়ে সেখানে। ২০০৪ সালের ১৫ই আগস্টে হাওয়া ভবনে অনুষ্টিত হয় আরেকটি বৈঠক। সেখানে মুফতি হান্নানের পরিকল্পনা শুনতে উপস্থিত ছিল রাজাকার ও জামাত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর, ডিজিএফআইয়ের সেসময়ের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম এবং তারেক রহমান।
আর্জেস গ্রেনেড, পাকিস্তান ও মাওলানা তাজউদ্দীন
হাওয়া ভবন থেকে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পর লুৎফুজ্জামান বাবর পাকিস্থানি নাগরিক মাজেদ ভাটকে নির্দেশ দেন আরজিএস মিলিটারি গ্রেড গ্রেনেড সরবরাহ করার। মাজেদ ভাট গ্রেনেড পৌঁছে দেয় সালাম পিন্টুর বাসায়। পিন্টুর বাসা থেকে ২০০৪ সালের ১৮ই আগস্ট মাওলানা তাজুদ্দিনের কাছ থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করে হান্নান। এখানে হান্নানের সঙ্গে ছিল হরকাতুল জিহাদের সামরিক শাখার নেতা আবু তাহের জান্দাল ও কাজল উপস্থিত ছিল।
রাষ্ট্রীয় সম্পৃক্ততা
২১শে আগস্ট হামলার পর, মাওলানা তাজউদ্দিনকে তড়িঘড়ি করে ভুয়া পাসপোর্ট দিয়ে পাকিস্থান পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেই পাসপোর্টে তার নাম ছিল বাদল। এই কাজে সহায়তা করেছিল তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই এর কর্মকর্তা এটিএম আমিন এবং সাইফুল ইসলাম ডিউক। বেগম খালেদা জিয়ার একাধিক মন্ত্রী, ডিজিএফআই ও এনএসআই মহাপরিচালক, উপদেষ্টা, এমপি এবং তারেক রহমান যেখানে সরাসরি এ ঘটনার সাথে জড়িত, সেখানে প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, তা বলার সুযোগ আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন বেশিরভাগ মানুষ।
এছাড়া তদন্তে উঠে আসে গ্রেনেডের আঘাতে বিধ্বস্ত ট্রাকে পড়ে থাকা অবিস্ফোরিত গ্রেনেড, লোকজনের ফেলে যাওয়া জুতা-স্যান্ডেলসহ অন্য সবকিছু ঘটনার স্থান থেকে সরিয়ে ঘটনাস্থলটি দ্রুত ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে ফেলা হয়। অর্থাৎ সব আলামত নষ্ট করে দেওয়া হলো। ঘটনাস্থলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কারখানায় তৈরি একটি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত অবস্থায় পাওয়া যায়। একই মডেলের গ্রেনেড পাওয়া যায় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের মধ্যে। যেখানে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা ছিল। বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতা ছাড়া এর কোন ঘটনাই ঘটা সম্ভব নয়।


প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২৩ | সময়: ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ