রোগীবান্ধব পরিবেশ ফিরছে রামেকে

শাহ্জাদা মিলন
মেইন গেট দিয়ে ঢুকতেই ফুলের বাগান। সারিবদ্ধভাবে গাড়ি ঢোকা ও বের হওয়ার সড়ক আলাদা। রোগি ও আত্নীয় স্বজনদের হাসপাতাল থেকে হেটে বের হওয়ার জন্য আলাদা সড়ক। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংয়ের কোন সুযোগ নেই এখানে। আনসার সদস্যদের অবিরাম মাইকিং ও গাড়িগুলোতে হাসপাতালে ঢোকা মাত্রই বের হওয়ার নির্দেশনা চলছে সারাক্ষণ। নেই সবসময় রোগী দেখতে আসা দর্শনার্থীদের ভিড়।
শীত ও গ্রীষ্মকালীন নির্দিষ্ট সময় ছাড়া অসময়ে কোন দর্শণার্থীকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। মাঝে মাঝে এ নিয়ে আনসার সদস্যদের সাথে দর্শণার্থীদের বাকবিতন্ডাও হচ্ছে। তবে হাসপাতালের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটিও জরুরী বলে মনে করা হচ্ছে হাসপাতাল কতৃপক্ষের কাছে। হাসপাতালের একাধিক সূত্রের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অনেক সময় একটি রোগীর জন্য ১৫/২০ জন চলে আসছেন ফলে অন্য রোগীদের সেটি বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে সেটি। অযথা রোগীর জন্য ভিড় করলে এটি সেবা দেয়ার সময় নার্স ও ডাক্তারদের কাজের ব্যাঘাত ঘটে। রোগীকে যত দ্রুত সেবা দিয়ে সুস্থ করে নিজ বাড়িতে ফেরত দেয়া মূল লক্ষ্য বলে মনে করছে তাই কিছুটা নিয়মের মধ্যে দিয়ে হাসপাতাল পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানালেন তারা।

এছাড়া রোগী ও লাশ পরিবহনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের ঘটনা এখন অনেকটা কমে এসেছে। নির্দিষ্ট কিলোমিটার দুরত্বের জন্য ভাড়া নির্ধারিত করা হয়েছে এখন। ফলে আগের চেয়ে অনেক টাকা বেঁচে যাচ্ছে বাসায় ফেরত যাত্রীদের।

প্রতিটি ওয়ার্ডে নতুন করে আনা হয়েছে বিন বা ময়না ফেলার বাক্স। যত্রতত্র পানের পিক, থুথু,ফলের খোসা কিংবা অপ্রয়োজনীয় কোন কিছু নির্দিষ্ট করে লেখা বাক্সে ফেলার জন্য অনুরোধ করে লেখা রয়েছে। এতে হাসপাতালের পরিবেশ কিছুটা হলেও রোগী বান্ধব হয়ে উঠেছে।
কুতুবউদ্দিন এসেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে তার মায়ের চিকিৎসার জন্য। জানালেন ৪৯ নং ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে মাকে। তিনি বলেন, এর আগেও পরিবারের সদস্যদের অসু¯’তাজনিত কারণে হাসপাতালে এসেছি। তবে এবার একটু পরিস্কার লাগছে তবে আরো বেশি পরিস্কার করলে বেশি ভালো হবে সবার জন্য। এছাড়া ডাক্তাররা আগের চেয়ে একটু ভালোভাবে চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করছেন। এখানে টেস্ট করার সংখ্যা ও ওষধ দেয়া হচ্ছে বেশি।

 

সোহেল নওহাটা থেকে এসেছেন বাবার চিকিৎসার জন্য। তিনি জানান, ডাক্তাররা সময় নিয়ে আব্বাকে দেখেছেন। আইডি কার্ড থাকায় লোকজন কম ঢুকতে পারায় হাসপাতালের পরিবেশ অনেক ভালো লাগছে বলে জানালেন। এছাড়া মেইন গেটের সামনে কোন গ্যাঞ্জাম নাই ফলে সহজে রোগী নিয়ে ঢোকা যাচ্ছে। রোগী ধরার দালাল আছে কিনা এ বিষয়ে তিনি বলেন,আমার নজরে আসেনি।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসাপতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম ইয়াজদানী বলেন, এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে জায়গা সংকট। রোগী ও তাঁর স্বজনরা এসেই চান একটি বেড। কিন্তু সেই বেড আমরা প্রথমেই দিতে পারছিনা। রামেকে ১২০০ বেড রয়েছে কিš‘ প্রতিদিন গড়ে ২০০০ রোগী ভর্তি হচ্ছে শীতের সময়ে। ফলে ৮০০ রোগীকে আমরা জায়গা দিতে পারছিনা।

আবার গরমের সময় রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩০০০ এর মতো হয়ে যায়। রোগীকে যে বাড়তি কোন বেড এনে দিয়ে সেবা দিব সে সুযোগ আমাদের নেই। আমি এখানে আসার আগে ঢাকার সিএমএইচে ছিলাম। সেই হাসপাতালতো অনেক পরিস্কার, আমি চেষ্টা করছি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী একটু গুছিয়ে সেবা দেয়ার। হাসপাতালের সামনের ও ভেতরের চিত্র পাল্টে দেয়ার চেষ্টা এখনো করছি। একজন রোগী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসে। এখানের পরিবেশ যদি তাকে মনস্তাত্ত্বিক ভাবে উজ্জীবিত না করে তবে সে সুস্থ হতে বেশি সময় নিবে। তাই আমরা চেষ্টা করছি বাইরে, ভিতরে রোগী বান্ধব পরিবেশ রাখার। এখানে যেসকল পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে সেটি যাতে বাইরে না করানো হয় সেবিষয়ে নির্দেশনা দেয়া আছে। এর পরেও যদি কোন ডাক্তার এমন কাজ করে তবে তার বিরুদ্ধে অফিসিয়ালী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি বলেন, হাসপাতালে এতো বেশি রোগী থাকে যে সবগুলো পরিস্কার করতে চাইলেও সম্ভব হচ্ছেনা লোকবলের অভাবে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কিছু লোক নেয়া হচ্ছে। আমাদের নতুন যে বিল্ডিংটা করা হয়েছে এটি দশ তলা বিশিষ্ট ফাউন্ডেশন দিয়ে করা হয়েছে। সেটিও ২০১২ সালে। কিন্তু সেটি চারতলাএখন পর্যন্ত হয়ে আছে। এটিকে কিভাবে দশতলা করা যায় সেই চেষ্টা চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে সবাই মিলে যদি রোগীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য এগিয়ে আসি তবে দশতলা করা সম্ভব। এই হাসপাতাল ১৯৫৮ সালে তৈরি ও ১৯৬৫ সালে সব ভবন কমপ্লিট করা হয় । তখনকার জনসংখ্যা হিসেবে এটি যথেষ্ট ছিলো কিন্তু এখন কয়েকগুন বেড়েছে মানুষ। রাজশাহী ছাড়াও কুষ্টিয়া,চুয়াডাঙ্গা,জয়পুরহাটসহ দূরদুরান্তের রোগীরা এখানে আসেন চিকিৎসার জন্য তাই জরুরী ভিত্তিতে এই ভবনটি করা দরকার।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরো বলেন,সদর হাসপাতাল এখনো চালু হয়নি। ফলে পুরো বিভাগের চাপ এই হাসপাতালে পড়ছে। ট্রলিতে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এই অভিযোগটি দীর্ঘদিনের। জোরপূর্বক অতিরিক্ত টাকার নেয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে রোগীর স্বজনরা যদি খুশি হয়ে কিছু দেয় সেটি নিতে পারে। তবে সেটিও ৫০ টাকার উপরে নয়।

খাবারের মান নিয়ে তিনি বলেন,আগে মনিটরিং ব্যবস্থায় হয়তো কিছু ত্রুটি ছিলো এখন আমি নিজেও মনিটরিং করছি। খাবারগুলো স্টুয়ার্ডদের সামনে বুঝিয়ে দিতে বলা হয়েছে । এখানে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। আগেতো লাইন ধরে খাবার দেয়া হতো। এখন চেষ্টা করছি বেডগুলোতে কিভাবে খাবার দেয়া সম্ভব সেটি নিয়ে। হয়রানি ছাড়া যতোটা সম্মানের সহিত রোগীদের হাসপাতাল ছাড়ানো যায় সেটি নিয়ে সেই চেষ্টা চলছে।

ড্রেনেজ ও টয়লেট সমস্যা বিষয়ে তিনি জানান, এখানে ড্রেনেজ সিস্টেম অনেক আগের করা । ফলে অনেক সময় ড্রেনের মাঝখানে স্পেশ কম থাকা ও ময়লা ফেলার কারনে ওভারলোড হয়ে পানি বেরিয়ে আসতো। আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে ডাস্টবিন দেয়ার চেষ্টা করছি যাতে কেউ ছুড়ে ড্রেনে ময়লা না ফেলে। আর সুয়ারেজ সিস্টেমের সমস্যা অনেক বেশি। রোগী ও স্বজনের টয়লেটে যেতে অনেক কষ্ট হয়। এখান থেকে পরিত্রানের জন্য সবকিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। করোনার প্রকোপ বাড়ায় নতুন করে পরিকল্পনা সাজানোর কথা ব্যক্ত করেন একই সাথে।

শামীম ইয়াজদানী জানান,করোনার কারনে অর্ধেক ডাক্তার কোয়ারেন্টাইনে থাকের আর অর্ধেক ডিউটি করেন। ফলে ডাক্তারের সংখ্যা কমে গেছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ডাক্তারদের সেবা আমরা আরো কয়েকগুণ বাড়াতে পারবো বলে বিশ্বাস করি।

সানশাইন / শামি

 


প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২২ | সময়: ৬:১২ অপরাহ্ণ | সুমন শেখ