সর্বশেষ সংবাদ :

ফুলেল শ্রদ্ধায় পান্না কায়সারের চিরবিদায়

সানশাইন ডেস্ক: শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় শেষ বিদায় জানানো হল লেখক, গবেষক, শিশু সংগঠক, সাবেক সংসদ সদস্য, শহীদজায়া পান্না কায়সারকে। সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ রোবাবর বেলা ১১টায় নেওয়া হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।
সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় শিশু কিশোরদের সংগঠন খেলাঘরসহ বিভিন্ন সংগঠন, শিক্ষক, সরকারের মন্ত্রী, রাজনীতিক, অভিনয় শিল্পী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। এ সময় পান্না কায়সারের মেয়ে অভিনেত্রী শমী কায়সারসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। শমী কায়সারের কথায় উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা লড়াইয়ে পান্না কায়সারের ভূমিকার চিত্র।
তিনি বলেন, “এমন একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশে মুক্তিযদ্ধের গল্প বলার মতো মানুষ ছিল না, ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছিল। তখন তিনি সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে শিশুদের জন্য খেলাঘর প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযদ্ধের চেতনায় একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেন।”
পান্না কায়সার দেশের নারীদের এগিয়ে চলায় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন মন্তব্য করে শমী কায়সার বলেন, “মা হিসেবে বলছি না, তিনি আমার কাছে মহীয়সী নারী। তাকে আমি কখনো কোনো কিছুতে হার মানতে দেখিনি। ৭৫ পরবর্তী যে পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিপর্যায়ের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। পান্না কায়সার একটার পর একটা যুদ্ধ করে গেছেন। নিজের ব্যক্তিগত দুঃখকষ্টকে তিনি কখনোই সামনে নিয়ে আসেননি। তিনি কষ্ট থেকে শক্তি অর্জন করেছিলেন।”
শিশু কিশোরদের সংগঠন ‘খেলাঘর’র প্রতিষ্ঠাতা পান্না কায়সার আজীবন সক্রিয় ছিলেন এই সংগঠনটির সঙ্গে। শহীদ মিনারে তার কফিনে শ্রদ্ধা জানানোর মিছিলে শুরুতেই ছিল এই সংগঠনটি। প্রথমে খেলাঘরের সারাদেশের প্রতিনিধি ও সদস্যদের একটি দল শ্রদ্ধা জানায়; পরে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংসদের নেতারা শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, নাট্যকার রামেন্দু মজুমদার, লেখক শাহরিয়ার কবির, সাংবাদিক শ্যামল দত্ত, চিত্রনায়ক ফেরদৌস, অভিনেত্রী আফসানা মিমিসহ আরও অনেকে।
শুক্রবার সকালে বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয় পান্না কায়সারকে। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওইদিন গুলশানের আজাদ মসজিদ এবং ইস্কাটনে জানাজার পর তার মরদেহ রাখা হয় বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে। সেখান থেকে রোববার সকালে মরদেহ আনা হয় শহীদ মিনারে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা পান্না কায়সার শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী।
বদরুন্নেসা কলেজের সাবেক এই শিক্ষক তার লেখার জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন তিনি। শহীদুল্লা কায়সারের চাচাতো ভাই, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, “শহীদজায়া পান্না কায়সারের লড়াইটা আর দশজনের মত নয়। তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মাত্র তিন বছরের সংসার তার। এরপরেই স্বামীকে হারান। মহান মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত-আল বদর যে বৃদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা তৈরির পরিকল্পনা করেছিল; তার ভুক্তভোগী হন তিনি। স্বামী শহীদুল্লা কায়সারকে হারান।”
পান্না কায়সারের পারিবারিক সংগ্রামের কথা উঠে আসে শাহরিয়ার কবিরের ভাষ্যে। তিনি বলেন, “১৯৭২ সালের মার্চ মাসে শহীদ পরিবারের সদস্যরা বঙ্গবন্ধুকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছিল। তিনি (পান্না কায়সার) সেই সময়েই তাতে যুক্ত হন। পরবর্তী ৫০ বছরে বহু ঝড়ঝাপ্টার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে।
“দুটি শিশুকে (শমী কায়সার, অমিতাভ কায়সার) আগলে রাখতে হয়েছে। তার এই পারিবারিক যুদ্ধ- সমস্ত শহীদ পরিবারের যুদ্ধের মতই। অনেক পরে হলেও পান্না কায়সারের চাওয়া- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। তিনি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের। তাদের সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
শ্রদ্ধা নিবেদন করে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “শহীদুল্লা কায়সার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর তিনি (পান্না কায়সার) সন্তানদের মানুষ করেছেন। তিনি আজীবন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। মুক্তিযদ্ধের চেতনাকে লালন করেতন তিনি। আমরা তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।”
পান্না কায়সারকে ‘আপসহীন’ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করে রামেন্দু মজুমদার বলেন, “স্বামীর মৃত্যুর পর অনেক কষ্ট করেছেন পান্না কায়সার। কিন্তু যে আদর্শকে তিনি বিশ্বাস করতেন, সেখানে কোনো আপোস করেননি। দুঃখ থেকেই শক্তি নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছেন।”
সাংবাদিক শ্যামল দত্ত বলেন, “বাংলাদেশে মুক্তিযদ্ধের চেতনায় প্রজন্ম গড়ে তোলার কাজটি দিনে দিনে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সেই কাজটি সহজ করে করার সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন পান্না কায়সার। মুক্তিযদ্ধের চেতনায় প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার যে অসমাপ্ত কাজ আমরা সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।“ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষেও শ্রদ্ধা জানানো হয়। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইও শ্রদ্ধা জানায়।
শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠান শেষ হয় দুপুর দেড়টার দিকে। সেখান থেকে পান্না কায়সারের মরদেহ নেওয়া হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে তার আরেক দফা জানাজা হয়। মিরপুরের শহীদ বুদ্ধীজীবী কবরস্থানে তাকে শায়িত করার কথা রয়েছে। ১৯৫০ সালের ২৫ মে পান্না কায়সারের জন্ম। তার পারিবারিক নাম সাইফুন্নাহার চৌধুরী। কলেজে পড়ার সময় ঢাকায় এক উচ্চবিত্ত পরিবারে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির অমানবিক পরিবেশ তার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে ফের পড়ালেখায় মন দেন পান্না। এইচএসসি পাস করে কুমিল্লা মহিলা কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি নেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন বাংলায় মাস্টার্স করতে। সে সময়ই পরিচয় হয় তরুণ বুদ্ধিজীবী, লেখক শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল এক দিনে কারফিউয়ের মধ্যে তাদের বিয়ে হয়। কিন্তু আড়াই বছরের মাথায় মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে স্বামীকে হারান পান্না কায়সার। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আলবদর বাহিনীর কিছু সদস্য শহীদুল্লা কায়সারকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। তার আর ফেরা হয়নি।
এরপর থেকে পান্না কায়সার একাই মানুষ করেছেন তার দুই সন্তান শমী কায়সার এবং অমিতাভ কায়সারকে। শিক্ষকতা করেছেন বেগম বদরুন্নেসা কলেজে, সেই সঙ্গে করে গেছেন লেখালেখি। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ: আগে ও পরে; মুক্তি; নীলিমায় নীল; হৃদয়ে বাংলাদেশ; মানুষ; অন্য কোনখানে; তুমি কি কেবলি ছবি; রাসেলের যুদ্ধযাত্রা; দাঁড়িয়ে আছ গানের ওপারে; আমি; না পান্না না চুনি; অন্য রকম ভালোবাসা ও সুখ।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় অবদানের জন্য ২০২১ সালে পান্না কায়সারকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।


প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২৩ | সময়: ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ