গঞ্জনা সয়েও ৯ মেয়েকেই শিক্ষিত করেছেন হাজেরা

অহিদুল হক, বড়াইগ্রাম: একটি ছেলে সন্তানের আশায় একে একে ৯ টি সন্তান নেন হাজেরা বেগম (৭৫)। কিন্তু সে ৯ সন্তানের একটিও ছেলে হয়নি তার। তার কোল জুড়ে একে একে আসা ৯টি সন্তানই মেয়ে। এ কারণে পরিবার ও প্রতিবেশীদের নানা তিরস্কার সইতে হয়েছে এই মাকে। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে হাজেরা বেগমকে তালাক দেয়ার জন্য তার স্বামীকে পরামর্শও দিয়েছেন। কিন্তু তবু দমে যাননি তিনি। ধৈর্য ও মনোবল নিয়ে মেয়েদের বড় করে তোলার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষিত করে তুলেছেন।
তাঁর মেয়েদের মধ্যে একজন সেনা কর্মকর্তা, দু’জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, একজন চিকিৎসক, একজন কলেজ শিক্ষক এবং তিন জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং একজন গৃহিণী। একদিন যারা তাঁকে উপহাস করতেন, এখন তাঁরাই এই মায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর পরম প্রিয় স্বামী তাঁকে ভালবেসে নাম দিয়েছিলেন অপরাজিতা আর ৯ মেয়ের প্রতি স্নেহের ছোঁয়া হিসাবে বাড়ির নাম দিয়েছিলেন নবরত্ন।
রত্নগর্ভা হাজেরা বেগম নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা ও সাবেক প্রধান শিক্ষক আবদুস সাত্তারের স্ত্রী। তিনি ২০০৯ সালে মারা যান। ৯ মেয়েকে সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর পৃথকভাবে জয়িতা ও বেগম রোকেয়া পুরস্কারে ভূষিত করেছে হাজেরা বেগমকে।
সম্প্রতি গল্পে গল্পে উঠে আসে সংগ্রামী এই মায়ের জীবন ইতিহাস। ১৯৬০ সালের মার্চে মাসে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় (১১ বছর বয়সে) বিয়ে হয় তাঁর। তখন স্কুলশিক্ষক স্বামী আব্দুস সাত্তার মাত্র ৩৬ টাকা বেতন পেতেন। দু-তিন বিঘা কৃষিজমি ছিল। এ সবের আয় দিয়ে চলত সংসার। বিয়ের চার বছরের মাথায় ১৫ বছর বয়সে প্রথম মেয়ে সন্তানের মা হন তিনি।
শ্বশুরবাড়ির পক্ষের চাওয়া ছিল একটি ছেলে সন্তান। তাঁদের চাওয়া পূরণে একে একে ৯ মেয়েসন্তানের মা হয়েছেন। এরপরও কোনো ছেলেসন্তানের জন্ম না হওয়ায় পারিবারিকভাবে তাঁকে কোণঠাসা হতে হয়। প্রতিবেশীরাও বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করেন। তবে স্কুলশিক্ষক স্বামীর উৎসাহে মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করার সংকল্প নেন।
স্কুলশিক্ষক আব্দুস সাত্তার মেয়েদের পড়ালেখার খরচসহ তাদের ভরণপোষণ দিতে গিয়ে শিক্ষকতার বাইরেও টিউশনি, সার্ভেয়ারের (জমির মাপজোখ) কাজ, বিয়ে নিবন্ধনসহ জমিতে পানি সেচের কাজও করেছেন। অর্থকষ্ট থাকলেও মেয়েদের পড়ালেখার কোনো ক্ষতি হতে দেননি হাজেরা বেগম ও আবদুস সাত্তার।
সম্প্রতি কথা হয় হাজেরা বেগমের পঞ্চম মেয়ে শামীমা আকতার সঙ্গে। তিনি বলেন, ছেলেসন্তান না থাকায় তাঁর মাকে অনেক লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে। তবু থেমে যাননি তারা। তাঁদের সফলতার পেছনে রয়েছে মা-বাবার স্বপ্ন ও পরিশ্রম। বাবা কম বেতনে চাকরি করায় অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁদের। এখন নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত সবাই।
হাজেরা বেগমের ছোট মেয়ে চিকিৎসক স্নিগ্ধা আকতার বলেন, বাবার মৃত্যুর পরও তাঁর মেডিকেলে পড়ালেখায় ছেদ পড়েনি। অন্য বোনেরা পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছেন। মাও ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। স্নিগ্ধা আকতারের স্বামী আইনজীবী এস এম শহিদুল ইসলাম। তাঁর বাবা আবুল কাশেম সরকার সংসদ সদস্য ছিলেন। শহিদুল ইসলামের ভাষ্য, তাঁর স্ত্রীর পরিবারের সবাই আদর্শ মানুষ। এ কারণে ওই পরিবারে বিয়ে করেছেন।
তার আরেক জামাই গোপালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামসুর রহমান শাহীন বলেন, দৃঢ় মনোবল আর অদম্য ইচ্ছা শক্তির জোরেই প্রতিকুল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করেও আমার শ্বাশুড়ি তার ৯ মেয়েকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমন মা যদি প্রতি ঘরে ঘরে থাকে তাহলে দেশটা সত্যিই সোনার দেশে পরিণত হবে।
মেয়েদের সাফল্যে গর্বিত মা হাজেরা বেগম বলেন, ছেলেসন্তান নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। তাঁর স্বামীর দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাঁদের দুজনের মনোবল, সাহস ও সততার কারণে মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করতে পেরেছেন। অনেকেই উপহাস করাসহ সংসার ভেঙ্গে দেয়ার পরামর্শ দিলেও আমার স্বামী সব সময় আমার পাশে ছিলেন। এ কারণেই আমি সন্তানদের শিক্ষিত করতে পেরেছি। বর্তমানে তারা নিজ নিজ যোগ্যতায় কর্মক্ষেত্রে সবাই সফল। আর কিছু চাওয়া নেই তাঁর।


প্রকাশিত: মে ১৪, ২০২৩ | সময়: ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ