বাঘার চরাঞ্চলে শিশুরাই হচ্ছে শিশুর মা !

নুরুজ্জামান,বাঘা : রাজশাহীর বাঘা উপজেলার প্রত্যান্ত এলাকা পদ্মার চরাঞ্চল। সেখানে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্রতা আর সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে বাড়ছে বাল্য বিয়ে। ফলে স্বাস্থ্য ঝুকি নিয়ে মা’হচ্ছে শিশুরা। উপজেলা সদর থেকে নদী বেয়ে অনেক দুরের একটি ইউনিয়ন হওয়ার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না। এর ফলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপস্থিতি সেখানে নেই বল্লেই চলে । আর এই সুযোগটিকে কাজে লাগাচ্ছে অনেক পিতা-মাতা।

পদ্মার কোলঘেঁষে সীমান্ত বাঘার বিস্তীর্ন পদ্মার চরাঞ্চল। এখানে শিক্ষার হার একে বারেই নিম্নগামী। প্রাইমারীর গন্ডি পেরুয় না অধিকাংশই কন্যা শিশুর। প্রক্ষান্তরে ছেলে শিশুদেরও একই অবস্থা। এখানে বাল্যবিয়ে যেন কোন ব্যাপরই না। এখানকার অধিবাসীরা অশিক্ষা আর কুশিক্ষায় নিমজ্জিত। সরকারী ভাবে ১৮ বছর বয়সের আগে মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে কঠোর বিধিনিষেধ থাকলেও চারাঞ্চলে এগুলো মানা হয়না। তের -চোদ্দ বছরের বয়স হলেই এখানকার মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয় হরহামেশে। এরপর চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যেই তারা মা’ হয়। এর ফলে অনেকই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আবার পারিবারিক কোলহের কারনে অনেকের সংসার ভেঙ্গে যায়।

সরেজিমন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চরাঞ্চলের অধিকাংশ পরিবার গরিব। তারা দিন আনে-দিন খাই। ফলে এ সকল পরিবারে কম-বেশি বাল্য বিয়ের ঘটনা ঘটেই চলেছে। পাইমারির গন্ডি পেরিয়ে সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেনীতে উঠলেই মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়। আবার অনেক শিশুর ক্ষেত্রে প্রাইমারী গন্ডিও পেরুয় না। নানা কারণে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে কুসংস্কার আঁকড়ে ধরে আছে।

বাঘা ব্রাক অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছর তাঁরা বাল্য বিয়ের কারণে সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে এ রকম 109 টি অভিযোগ পেয়ে ছিলেন। এর মধ্যে খোলা তালাকের মাধ্যমে 76 টি মিমাংসা করতে সক্ষম হয়েছেন। এদিক থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত 30 টি অভিযোগ পেয়েছেন। এ সব অভিযোগ অধিকাংশই পদ্মার চরাঞ্চলের ।

চরাঞ্চলের দিন মজুর নাজমুল ইসলাম বলেন, মেয়ে বড় হলে বিয়ে দেয়ার সমস্যা । যেহেতু মেয়েকে বিয়ে দিতেই হবে , সেহেতু আগে দেয়াই ভালো। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বিবেচনা করে তো কেউ বিয়ে দেয়না। যুগ-যুগ ধরে এখানে এই অবস্থা চলে আসছে। তাই আমরাও করে আসছি।

চকরাজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক লাইলী বেগম ও মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, চরাঞ্চলে বাল্য বিয়ের কারনে স্বাস্থ্ ঝুকি নিয়ে মা হচ্ছে শিশুরা।এ জন্য পিতা-মাতেকে একক ভাবে দায়ি করা যাবে না। কারণ অনেক শিক্ষার্থী প্রনয় ঘটিত কারনে একে অপরকে ভালবেসেও বিয়ে করেছে। তবে এ অঞ্চলে বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে প্রশাসনের উপস্থিতি নেই বল্লেই চলে।

এ বিষয়ে গাইনি চিকিৎসকরা বলেন, আঠারোর আগে শারিরীক মানসিক কোন দিক দিয়েই একটি মেয়ে বিয়ে এবং গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হয় না। সন্তান ধারণের জন্য শরীরের প্রস্তুতি প্রয়োজন। “পিউবার্টি বলি আমরা যে বয়সে প্রথম পিরিয়ড হবে-তার পরে আস্তে আস্তে তার বডিটা ডেভলপ করবে। এই ডেভলপমেন্টের জন্য একটা সময় দিতে হয়। পনের থেকে আঠার বছর পর্যন্ত এই শরীর গঠন চলতে থাকে। আঠারো বছরের আগে যদি মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয় তখন তার প্রপার গ্রোথ হয় না। এক্ষেত্রে গর্ভধারণ করলে প্রিম্যাচিওর ডেলিভারির শঙ্কা থাকে। যেটি শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি করে।” তাঁদের মতে,বাল্য বিবাহ মেয়েদের স্বাস্থ্যে সমস্যার পাশা-পাশি শিশু মৃত্যুরও অন্যতম কারণ এবং এটি দেশের উন্নয়নেও নানা ভাবে বাধাগ্রস্থ করছে।

সার্বিক বিষয়ে বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পাপিয়া সুলতানা বলেন, একজন শিশুর পেট থেকে আরেকজন শিশুর জন্ম হবে এটা আমাদের কাম্য নয়। সরকারি ভাবে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে দিতে বারণ এটা জানেন-না এমন কোন মানুষ নেই। তার পরেও অতি গোপনে শুধু বাঘার চরাঞ্চল নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকাতে এর কম-বেশি প্রভাব রয়েছে। এ জন্য অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্রতা আর সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ অন্যতম বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সার্বিক বিষয়ে বাঘা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শারমিন আখতার গত মাসিক আইন শৃংখলা মিটিং-এ বাল্য বিয়ে প্রসঙ্গে বলেন, এটি প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন জনসচেত না। তিনি এ বিষয়ে সুশীল সমাজ, জনপ্রতিনিধি ,এলাকার অভিজ্ঞ মহল, পুলিশ, ইমাম এবং শিকক্ষদের বাল্য বিয়ের কুফল সম্পর্কে বেশি-বেশি করে বক্তব্য উপস্থাপনের আহবান জানান এবং এ সংক্রান্তে তাঁকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করার অনুরোধ জানান।

 


প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০২৩ | সময়: ১২:২২ অপরাহ্ণ | সানশাইন